মূল্যস্ফীতি, মন্দা ও বেকারত্ব সমাধান বাজেটের মূল দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
বিশ্বব্যাপী যখন অর্থনীতি স্ট্যাগফ্লেশনের (একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি, শ্লথ প্রবৃদ্ধি, ও বেকারত্ব) দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখন এবারের বাজেট আগের অনেক বাজেটের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মূল প্রশ্ন হচ্ছে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের সংকট মোকাবিলায় আসলে কতটা সহায়ক হতে যাচ্ছে। এবারের বাজেটে এই ২টি সমস্যা একই সঙ্গে কীভাবে সমাধান হবে সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। বরং মনে হয়েছে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ শুধু একটা সংখ্যা বসিয়ে দিয়ে দায় শেষ করা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর জন্য ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেই মনে হচ্ছে দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সংকট দূর করে ফেলা হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে আর ঋণ মওকুফ করলেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বিনিয়োগ করবে এবং তা থেকে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে—এমন একটি ধারনাই বারবার মানুষকে দেওয়া হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতির সময় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা কীভাবে বাড়বে
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে মূল্যস্ফীতি কমলে, অথবা তাদের আয় বাড়ালে। যেহেতু মূল্যস্ফীতির পেছনে স্থানীয় কারণের পাশাপাশি এবার বৈশ্বিক কারণও যুক্ত হয়েছে, তাই আমদানিকৃত অনেক দ্রব্যের দাম কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এবারের বাজেটে কিছু দ্রব্যের (যেমন, ভোজ্যতেল, এলপিজি বাল্ক ক্রয়, গবাদিপশুর খাবার) দাম কমানোর জন্য কর, আমদানি শুল্ক, ভ্যাট কমানো হলেও তা মূল্য কমাতে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না।
এলপিজি বাল্ক ক্রয়ে কর অব্যাহতি দিলেও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এলপিজির দাম সহনশীল পর্যায়ে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরই মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে বেড়েছে আরও ৭ টাকা। এ ক্ষেত্রে বাজারের সরবরাহ ও চাহিদাকেই দায়ী করা হচ্ছে। প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়লে শুধু শুল্ক কমিয়ে বাড়িয়ে বাজারে সরবরাহ ও চাহিদা নিয়ন্ত্রণের কৌশল একটি বাজারমুখী সমাধান। এই সমাধান প্রায়শই অকার্যকর হয় যদি পণ্যের বাজার হাতেগোণা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকে, আমদানি নির্ভরতা বেশি থাকে, টাকার অবমূল্যায়ন বেশি হয়। ভোজ্যতেল এরকম একটি উদাহরণ।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকার ভর্তুকি বাড়ালেও বিদ্যুৎ, এলপিজি, গ্যাসের দাম বাজেট নির্ধারণের আগেই বাড়তি ছিল। এর প্রভাব পড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খরচে। কাজেই দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের দাম যে উপায়ে কমানো যেত তার পথটিও খোলা রইলো না। আবার বিদ্যুৎ খাতে যে ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তা যতটা না মূল্য কমাতে, তারচেয়ে বেশি উৎপাদকদের অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে। কাজেই ভর্তুকি দিলেই হবে না। এর সুফলতা কোন শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে সেটাই দেখার বিষয়। পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, এই ভর্তুকি ভোক্তাদের সুফলতা বৃদ্ধিতে কাজে আসছে না। বরং বেসরকারি উৎপাদকদের সুফলতা বাড়ছে।
এবার আয়ের দিক থেকে যদি দেখি, এবারের বাজেটে বিনিয়োগযোগ্য আয়সীমা ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে এ বছর থেকে ১৫ লাখ টাকা বেশি আয়ের করদাতাদের কর রেয়াতের হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এই পরিবর্তনে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত করদাতারা আগের চেয়ে রেয়াত কম পাবেন। অন্যদিকে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা কর রেয়াত বেশি পাবেন। ফলে নিম্নআয়ের করদাতার ওপর করের বোঝা বাড়বে এবং তার হাতে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য টাকা কম থাকবে। এ ছাড়া বিদ্যমান পরোক্ষ করের (ভ্যাট) কাঠামো ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য সমান। এতে ধনীদের তুলনায় দরিদ্রের ক্রয়ক্ষমতার অপেক্ষাকৃত বেশি কমবে।
মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে সামাজিক সুরক্ষা ভাতা সেভাবে বাড়েনি। যেমন প্রতিবন্ধী ভাতা বেড়েছে মাসে ১০০ টাকা। ১০০ টাকা বেশি দিয়ে প্রতি মাসে ক্রয়ক্ষমতা এমনকিছু বাড়ছে না যা দিয়ে সুষম খাবার খাওয়া যায়। তাছাড়া ৭০০-৮০০ টাকা দিয়ে কী পাওয়া যায়? শুধু খাদ্য ছাড়াও মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে বাসস্থান, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রয়োজন। সামাজিক সুরক্ষার অপ্রতুলতা আগেও ছিল, এখনো রয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তায় কম বরাদ্দ সরকারের জন্য লজ্জার। তাই এ থেকে বাঁচতে বরাবরই বরাদ্দ বেশি দেখায় সরকার। কিন্তু তাতে শুধু অতিরঞ্জনই হয়। এ বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৫ হাজার কোটি টাকাই এমন সব খাতে ব্যয় হবে যাকে ঠিক সামাজিক নিরাপত্তা বলা যায় না। যেমন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, অবসরভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, করোনার কারণে ব্যাংকের সুদ মওকুফ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুদ ভর্তুকিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
২৪টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নগদ সহায়তা, খাদ্য সহায়তা ও কর্মসৃজন, বৃত্তি, বিশেষ সহায়তা, বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়ে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতের আওতায় ১১৫টি বিষয় বা কর্মসূচি রয়েছে। উপকারভোগী নির্বাচনের সমস্যা, তথ্যের অভাব এরই মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে রেখেছে। এর আগে ২০১৬ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জানিয়েছিল যে দেশের ৬৪ শতাংশ দরিদ্র মানুষ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর একটির সুবিধাও পায়নি। করোনার সময়ও এর দুর্বল দিকগুলো বারবার উন্মোচিত হয়েছে।
বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির সময় বাংলাদেশে দাম সহনশীল করার মেকানিজম কি আদৌ রয়েছে
বাজারমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের হাতে দাম কমানোর ইন্সট্রুমেন্টগুলো হচ্ছে শুল্ক, ভ্যাট কমানো, ক্রয়ে ভর্তুকি ইত্যাদি। এর বাইরেও বাজারে কে কী বিক্রি করছে ও বাজারে কার কত অংশীদারিত্ব বা আধিপত্য আছে সেটা দিয়ে অনেকসময় বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তৈরি হয়। সেটা হুট করে পরিবর্তন করা যায় না। আজকে একটা বহিস্থ কারণ যেমন যুদ্ধ, মহামারি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সরবরাহ সংকট তৈরি হলে কালকেই সেটা ঠিক করে ফেলার সহজ মেকানিজম সরকারের কাছে থাকে না। যদি না পূর্ব পরিকল্পনা করে একটা কাঠামো দাঁড় করানো না যায়। সেখানে সরকার হুট করে দ্রুত হস্তক্ষেপ করে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই কাঠামো জনবান্ধব করতে হলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সক্ষমতা লাগে। যেমন কৌশলগত ভাবে কিছু পণ্যের আমদানি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা, মজুদ রাখা, যা দ্রুত সরবরাহ করে সংকটকে সামাল দিতে পারে। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেই যদি দেখি, ভোজ্য তেল উৎপাদন ও আমদানি যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতো তাহলে এই মজুদটা সরকার করতে পারতো। সংকটের সময় সরকার মজুদ থেকে সরবরাহ করতে পারতো। এখানে উল্টো হলো। মজুদ করে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। অবৈধভাবে মজুদ করা তেল উদ্ধারে অভিযান চালাতে হলো। আবার এটা করেও দাম নিয়ন্ত্রণে রইলো না। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমলেও তেলের মূল্য সেভাবে কমানো সম্ভব হলো না বাজারমুখী সমাধানের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে।
নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতা, গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর ওপর বাজারের নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদকদের অবৈধ কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগের অভাব—সবকিছুই দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য দায়ী। কাজেই দীর্ঘমেয়াদে কৃষি, খাদ্য, শিল্পের উন্নয়নে সরকার কী প্রণোদনা দিচ্ছে এবং দিয়ে আসছে, আর কী ধরনের কাঠামো দাঁড়াচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে সরকার আপদকালীন সময়ে কীভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
কৌশলগত ভাবে কিছু শিল্প যেমন তেল, চিনি, আটা, লবণ, দুধ, সার, বীজ— এই পণ্যের বাজারে সরকারের ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণে থাকা দরকার। তেমনিভাবে কৃষি পণ্য যেমন চাল, গবাদিপশুর খাদ্য, গম, ডালের জন্য বাজারে কৃষক যেন সঠিক দাম পায় তা নিশ্চিত করতে সরকারকে নির্ধারিত দামে সময় মতো খাদ্যশস্য কিনে নেওয়ার সক্ষমতা দরকার। গুদামজাত করার সুবিধা সৃষ্টি করা দরকার এবং দ্রুত কিনে ফেলার একটা তৎপরতা দরকার।
বাজেটে কৃষিতে সরকার ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ালো না কমালো তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকার ভর্তুকি কাকে দেবে, কীভাবে দেবে, কখন দেবে। ভর্তুকির টাকা যদি কতিপয় ব্যবসায়ীর পকেট ভারী করে তাহলে কৃষক বা জনগণ কেউই লাভবান হবে না। সরকার যদি নির্ধারিত দামে কৃষকের কাছ থেকে চাল, পেঁয়াজ এগুলো সময় মতো কেনে এবং সরাসরি বেশি মানুষের মাঝে রেশনের মাধ্যমে কম দামে বিতরণ ব্যবস্থার একটা অবকাঠামো দাঁড় করাতে পারে তাহলে ভোক্তা ও কৃষক উভয়ই উপকৃত হয়। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় বাজেটে কৃষি ভর্তুকি বাড়িয়ে যদি দাবি করা হয় তা খাদ্য সংকট মোকাবিলায় এর ভূমিকা থাকবে তাহলে তা হবে খুবই সীমিত পরিসরে। যার সুফল দেশের মানুষ সমানভাবে পাবে না। সীমিত কিছু মানুষ হয়তো এর সুফল পাবে, যারা আগেও সেই সুফলতা পেয়ে আসছিল।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাজেট প্রস্তাব আসলে কতটা কার্যকর
বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ও মন্দা হলে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলো প্রথমেই যা চেষ্টা করে তা হলো—ক্রয়ক্ষমতা ও পণ্যের চাহিদা যেন কমে না যায় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। কারণ ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতির উৎপাদনের, সরবরাহের, এবং কর্মসংস্থানের সংযোগ রয়েছে। যখন মূল্যস্ফীতি, মন্দা ও বেকারত্ব একই সঙ্গে বাড়ে, তখন যদি মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় তাহলে উৎপাদকেরাও সরবরাহ কমিয়ে দেয়, শ্রমিক ছাটাই হয় এবং একটা সংকট আরেকটা সংকটকে ত্বরান্বিত করে। এভাবে অর্থনীতি আরও বড় মন্দার দিকে ধাবিত হয়। তাই ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে চাহিদা বাড়ানোর জন্য এমনকিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, যা পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান তৈরির শর্ত তৈরি করে। কিভাবে পরোক্ষভাবে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ালে কর্মসংস্থান বাড়ে?
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের দর্শন হলো উৎপাদদের প্রণোদনা দেওয়া, কর অব্যাহতি দেওয়া, যেন তারা বিনিয়োগ বাড়ায় এবং নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থান তৈরি হয়। ধরে নেওয়া হয়, প্রণোদনার সুফল নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পর্যন্ত চুইয়ে পৌঁছাবে। কিন্তু এর আগেও আমরা দেখেছি শ্রমিকদের মজুরি ভাতা বাড়াতে বা তাদের জীবনে উন্নতি করতে এ ধরনের প্রণোদনা খুব একটা কাজে লাগেনি। উল্টো কিছু মালিকপক্ষ এর সুবিধা ভোগ করেছে। এসব প্রণোদনা চুইয়ে পড়ার যে কথা বলা হয়েছে তা আসলে শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছেনি। শ্রমিকের মজুরি ভাতা বাড়ানো যায়নি। যেহেতু এই পদ্ধতি কার্যকর না, তাই এরকম উদ্যোগ না নিয়ে অন্যভাবে ভাবা প্রয়োজন ছিল। সেই অন্য উপায়টা কি?
ক্রয়ক্ষমতা নির্ভর করে পণ্যের মূল্যে ও আয়ের উপর। শ্রমজীবী মানুষের মজুরি বৃদ্ধি করে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোই উচিৎ। কিন্তু বাংলাদেশে এ রকম মূল্যস্ফীতি বাড়লে প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরি বোর্ড বসে না। বরং উল্টো উৎপাদকদের প্রণোদনা দিয়ে আশা করা হয় তা মজুরি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। মূল্যস্ফীতি যখন বাড়ে, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে ব্যবসায়ীদের কর কমালে তা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে কোনো অবদান রাখে না, সেখানে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পরোক্ষ পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। যেমন রেশন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ।
এ ছাড়া মৌলিক কিছু খাত, যেমন চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান, পরিবহণ সুবিধা সামর্থ্যের মধ্যে রাখা। এসব মৌলিক চাহিদার জন্য মানুষকে যখন আয়ের বৃহৎ অংশ খরচ করতে হয় না, তখন তার খরচযোগ্য আয় অন্য পণ্য ক্রয়ে ব্যবহার করতে পারে। এভাবে পরোক্ষভাবে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে তা একদিক থেকে সামাজিক সুরক্ষা যেমন দেয়, তেমন স্থানীয় পণ্যের চাহিদা তৈরি করে এবং অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে।
এখন যে পদ্ধতিতে করপোরেট কর কমিয়ে, ঋণ দিয়ে, সুদ মওকুফ করে, প্রণোদনা দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে তা আগেও যে কারণে কার্যকর ছিল না। এখনো সেই কারণেই কার্যকর হবে না। এই অর্থনৈতিক সংকটের সময় চাহিদা বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করলে বরং আরও কার্যকর ভাবে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সংকট মোকাবিলায় বাজেট একটা ভূমিকা পালন করতে পারতো।
কোন খাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে
আমরা রপ্তানি খাতে যত প্রণোদনাই দেই না কেন, তাতে বিশ্বজুড়ে চাহিদা কমলে উৎপাদন প্রণোদনাও কমে যতে পারে। কাজেই বিশ্বের চাহিদার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না হয়ে, স্থানীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এ থেকে ২টি সুফল আসবে। তাহলো— বৈশ্বিক চাহিদার ওপর নির্ভরতা কমবে এবং স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। সরকার যদি সত্যিই স্ট্যাগফ্লেশনের সময় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সংকট সমাধানে আগ্রহী হয় তাহলে শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও পরিবহনের পাশাপাশি স্থানীয় শিল্প, সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার ছিল।
শহরের আনাচে-কানাচে শ্রমজীবী মানুষ প্রতি বর্গফুট হিসাব করলে অভিজাত এলাকার প্রতি বর্গফুটের চেয়েও বেশি ভাড়া দেয়। অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে বড় হয় তাদের শিশু। শহরের নিম্নবিত্তের বাসস্থানের মান ও ভাড়া নিয়ন্ত্রণের একটা মেকানিজম দাঁড় করাতে হবে। শ্রমজীবীদের জন্য শহরের মাঝখানে এলাকাভিত্তিক বাসস্থান নির্মাণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি যেসব এলাকায় তারা থাকেন সেসব এলাকায় ভাড়া নিয়ন্ত্রণের একটা পদ্ধতি বের করতে হবে। মূল্যস্ফীতির অজুহাত দেখিয়ে ভাড়া বাড়ানোর যে কৌশল অব্যাহত রয়েছে তা প্রতিহত করতে হবে।
রেশন বিতরণের জন্য দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক চালু করতে হবে। এ জন্য এলাকাভিত্তিক গুদাম, বিক্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা, পরিবহন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা ভাতা বিতরণে তালিকা জবাবদিহিমূলক করতে হবে। করোনার সময় সুবিধা বঞ্চিতদের শনাক্ত করার কোনো অবকাঠামোই ছিল না। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বিপদের সময় সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়নি। অরাজকতা, চুড়ি, লুটপাট—এগুলো বন্ধ করা যায়নি। সর্বজনের গ্রহণযোগ্য একটি বিতরণ নেটওয়ার্ক চালু করা এখন সময়ের দাবি।
স্থানীয় শিল্প, যেমন চিনিশিল্প, খাদ্যশিল্প, পাটশিল্প, ব্যাটারিচালিত রিকশাশিল্প, রেলওয়ে, বিনোদন, পর্যটন—যেসব খাতে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সরাসরি এর সুফল পায় সেই খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজন হলে ভর্তুকি দিয়ে এগুলোর টেকসই উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কথা বলা আছে। কিন্তু বরাদ্দ যেভাবে দেওয়া হয়েছে তা আসলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যের সঙ্গে কাঠামোগত ভাবেই সাংঘর্ষিক।
মোশাহিদা সুলতানা, সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Comments