জাহাঙ্গীরের নাটকীয় উত্থান-পতন

বয়স চল্লিশের কোঠা পেরুনোর আগেই তিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র বনে যান।
jahangir.jpg
জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: সংগৃহীত

বয়স চল্লিশের কোঠা পেরুনোর আগেই তিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র বনে যান।

দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, ঘনিষ্ট সহচরদের পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ উৎস থেকে নগদ অর্থের যোগান ও ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ জাহাঙ্গীর আলমকে খুব দ্রুত গাজীপুর আওয়ামী লীগের শীর্ষে পৌঁছে দেয়।

তবে তার পতন ঘটে আরও দ্রুততার সঙ্গে। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় ৪২ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। এর জের ধরে গত ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটি। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে।

জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দ্রুত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হতে পারে। সেই সঙ্গে মেয়র পদও হারাতে পারেন তিনি।
এ বিষয়ে গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের এক সদস্য বলেন, 'তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনে জাহাঙ্গীর এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি ভেবেছিলেন কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একাংশের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন।'

গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খানের ভাষ্য, জাহাঙ্গীরের অপসারণে আওয়ামী লীগ লাভবান হবে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'তার (জাহাঙ্গীর) বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ছিল যে, তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। এটা দলের জন্য ক্ষতিকর ছিল। তার বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা দলকে আরও বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছে।'

নগর আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতার বক্তব্য, অভিযোগের তদন্ত না হওয়ায় আগে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিস্তর অভিযোগ

গাজীপুর শহরের অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে সিটি করপোরেশন তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি 'অধিগ্রহণ' করেছেন। পাশাপাশি রাস্তা, ড্রেন ও ফুটপাত প্রশস্ত করার জন্য তাদের ভবনগুলো ভেঙে ফেলায় তারা মূল্যবান জমি হারিয়েছেন। বেশিরভাগ বাসিন্দাদের দাবি, এ জন্য তারা কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পাননি।

নগরীর সালনা এলাকায় মোসলেম উদ্দিন ও তার স্ত্রী সেতারা বেগমের ৪ কাঠা জমি আছে। জমির ওপর একটি ৩ তলা পাকা ভবনের পাশাপাশি একটি আধাপাকা ঘর ছিল।

জাহাঙ্গীর ও তার অনুসারীরা ১৩ নভেম্বর ওই দম্পতিকে রাস্তার জায়গা বের করার জন্য মূল ভবনের অর্ধেক ও আধাপাকা ঘরের ২টি কক্ষ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন।

সেতারা বলেন, 'বাড়ির যে অংশগুলো ভেঙে ফেলতে হবে, সেগুলো তারা চিহ্নিত করে দেন। ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, তারা কেবল ভবন ভাঙার খরচ দেবেন।

সেতারা বেগমের ভাষ্য, 'এটা জবরদখল… মেয়র হিসেবে জাহাঙ্গীর নাগরিকদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিলেন।'

হরিনাল এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি দেড় কাঠা জমি ও ভবনের একটি অংশ হারিয়েছেন। বলেন, 'আমার বাড়িটা ছিল ৪ কাঠা জমির উপর। সিটি করপোরেশন এটা অধিগ্রহণ করেনি। তারা আমার ভবন ও দেয়ালের কিছু অংশ ভেঙে দেয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমি কিছুই পাইনি।'

মেয়র তার সহযোগীদের মাধ্যমে রফিকুলদের তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'আমিসহ ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক জন ২ বার সেখানে গিয়েছি কিন্তু মেয়র আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি।'

ক্ষতিগ্রস্ত এমন ডজনখানেক ব্যক্তি একইভাবে তাদের হতাশার কথা জানান। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, গাজীপুর ও আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা পোশাক কারখানাগুলোর ঝুট কাপড়ের ব্যবসায় জাহাঙ্গীরের একচেটিয়া আধিপত্য। এটা তার আয়ের অন্যতম উৎস।

গত বছরের নভেম্বর মাসে হাইকোর্ট বিভাগ কাশেম ল্যাম্পস লিমিটেডের জমি, বাইমাইল এলাকার কাশেম গ্রুপের গেস্ট হাউস ও ইটাহাটায় এসকর্ট প্যাকেজিং কারখানার সম্পত্তি দখলের বিষয়ে স্থিতাবস্থার আদেশ দেন।

ওই আদেশ সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন গত ১৯ ও ২০ আগস্ট জয়দেবপুরের বাইমাইলে কাশেম ল্যাম্পস লিমিটেডের কারখানা ও গেস্ট হাউসের জমির একাংশ দখল করে। স্থাপনা ও সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলে। কারখানার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আবুল আলা বলেন, 'হাইকোর্টের স্থিতাবস্থার আদেশ কাশেম ল্যাম্পস লিমিটেডের ফটকে টানানো ছিল। মেয়রের নির্দেশে তারা সেটা ভেঙে দেয়।'

এ ছাড়া, অভিযোগ আছে জাহাঙ্গীর সিটি করপোরেশনের টাকায় দলীয় বিলবোর্ড তৈরি করেছেন এবং তার নামে গড়ে তোলা একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ৩ শতাধিক কর্মী সিটি করপোরেশন থেকে টাকা পান।

শনিবার সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীর জানান, তিনি রাস্তা নির্মাণের পাশাপাশি তা প্রশস্ত করার জন্য নগরের বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রায় ৮ হাজার বিঘা জমি পেয়েছেন। তিনি বলেন, 'পৃথিবীর এমন কোনো দেশ বা শহর নেই, যেখানে ৩২ হাজার বাড়ি ও দোকানমালিক রাস্তার জন্য তাদের জমি ছেড়ে দিয়েছেন। আমি যে জমি চেয়েছিলাম, তারা (গাজীপুরের বাসিন্দা) স্বেচ্ছায় তা দিয়েছেন।'

গাজীপুর শহরে ২ হাজার ৬০০ কারখানা আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'আমি আমার জীবনে কোনো মালিকের কাছ থেকে টাকা নিইনি। যখনই মানুষ জমি সংক্রান্ত কোনো সমস্যায় পড়েছে, আমরা সেটা সমাধান করেছি।'

জাহাঙ্গীরের উত্থান ও পতন

জাহাঙ্গীর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে, ছাত্র হিসেবে। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি গাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

২০১৩ সালে তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি। ওই বছরের শেষ দিকে তিনি গাজীপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পরে ২০১৮ সালে তিনি মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হন।

দলের ভেতরকার লোকজন বলছেন, মেয়র পদে বিজয়ী হওয়ার পর জাহাঙ্গীর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি ও আজমত উল্লাহর মতো প্রভাবশালী নেতাদের দূরে সরিয়ে দেন।

স্থানীয় একজন জ্যেষ্ঠ নেতার বক্তব্য অনুসারে, 'তিনি (জাহাঙ্গীর) এলাকায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।'

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২ মাস আগেও আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ কেউ করেনি। আপনারাও আমাকে প্রশ্ন করেননি। আজকে অমি বেকায়দায় পড়েছি তাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ করা হচ্ছে। আমি কোনো ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা কারো জমি-জমা আত্মসাৎ করেছি এমন কোনো ঘটনা কেউ দেখাতে পারলে আমার বিচার করেন। আমাকে মনে হয় ফাঁসি দিতে পারলে তারা (যারা ষড়যন্ত্র করছে) খুশি হবে। আমাকে ফাঁসি দিয়ে দিন। আমি আমার ফাঁসি ফেরানোর জন্য উকিলও নিয়োগ করবো না।'

নিজের পরিবারের লোকজনকে বরাবর রাজনীতি ও ক্ষমতাসম্পর্ক থেকে দূরে রেখেছেন দাবি করে এই জনপ্রতিনিধি আরও বলেন, 'আমার পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি না এসে বা কারো ফাইল আমার পর্যন্ত না এনে যদি আমাকে দোষারোপ করে, তাহলে আমি কী বলব? কেউ আমার কাছে ফাইল দেওয়ার পর সেটা আমি ফেরত পাঠিয়েছি, এমন ঘটনা কেউ বলতে পারবে না।'

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments