‘৩ বেলার বদলে এখন দুবেলা খাচ্ছি’

মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে ফুটপাতের একটি হোটেলে বসে ভাত খাচ্ছিলেন জীবন মিয়া (৪০)। তার প্লেটে ভাত, আলুভর্তা আর একটি কাঁচামরিচ।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে ফুটপাতের একটি হোটেলে বসে ভাত খাচ্ছিলেন জীবন মিয়া (৪০)। তার প্লেটে ভাত, আলুভর্তা আর একটি কাঁচামরিচ।

ভাত খেতে খেতেই আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে জীবন মিয়ার সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।

ভাতের সঙ্গে আর কিছু নেবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আর কী লমু কন? আগে দুই প্লেট ভাত, ডাল আর ভর্তার প্যাকেজ খাইতাম ৩০ টাকা দিয়া। ঈদের পর থাইকা ৪০ টাকা লয়। রিকশার জমার টাকাও ২০ টাকা বাড়াইছে। সবকিছু বাড়ছে, কিন্তু ইনকাম তো বাড়ে নাই। আগে ৩ বেলা খাইতাম এখন ২ বেলা খাই।'

জীবন মিয়ার বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বারে। স্ত্রী ও ৩ সন্তান নিয়ে থাকেন রাজধানীর কমলাপুরে। বাসা ভাড়া, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ, পরিবারের অন্যান্য খরচ সব মিলিয়ে এখন তার ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। কিছুদিন আগেও প্রায় ২৫ হাজার টাকা দিয়ে তার সংসার ভালোভাবেই চলে যেত।

জীবন মিয়া বলেন, 'সবকিছুর দাম বাড়ছে। কিন্তু আমাগো তো আয় বাড়ে নাই। আমরাও কাউরে বেশি ভাড়ার কথা কইতে পারি না। কারণ তাগো অবস্থাও তো ভালো না।'

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খাবারের দোকানগুলোতে। সরেজমিনে রাজধানীর মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, গ্রিনরোড, বারিধারা, গুলশান, বনানীসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ফুটপাতের হোটেলগুলোতে ভাত ছাড়া প্রায় প্রতিটি খাবারের দাম ১০ টাকা করে বেড়েছে। অল্পকিছু হোটেলে দাম না বাড়ালেও কমানো হয়েছে খাবারের পরিমাণ।

streer-food1_ds.jpg
মতিঝিলে ফুটপাতে একটি ভাতের হোটেল। ছবি: স্টার

মতিঝিলের বিভিন্ন সড়কে ফুটপাতের দোকানগুলোতে ডিম, পাঙাস মাছ, তেলাপিয়া মাছ, রুই মাছ ১০ টাকা করে বেড়ে যথাক্রমে ৩০ টাকা, ৪০ টাকা, ৫০ টাকা ও ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুরগি ও গরুর মাংসও ১০ টাকা বেড়ে প্রতি প্লেট যথাক্রমে ৬০ টাকা ১৩০ টাকা হয়েছে। মতিঝিলের এসব হোটেলগুলোতে মূলত নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা নিয়মিত খাবার খান।

গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেট, গুলশান-২ এর কাঁচাবাজার এলাকা ও বনানী ১৭ নম্বর রোডে সড়কের পাশের খাবারের দোকানগুলোতেও একই অবস্থা দেখা গেছে। মূলত নিম্ন কিংবা মধ্য আয়ের মানুষেরা এসব হোটেলে খেতে আসেন। সেখানকার এই হোটেলগুলোতে মুরগি ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০, গরু ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ আর মাছ ৭০-৮০ টাকার বদলে ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আজ দুপুরে গুলশানের ডিএনসিসি কাঁচাবাজারের পাশের একটি হোটেলে বসে সবজি দিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন ইলেকট্রিশিয়ান মো. হাসান (৩২)। খাবারের দাম নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, 'সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে, সামনে তো আমাদের মতো মানুষের বাঁচাই কষ্টকর হয়ে যাবে। সবকিছুর দামের এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমরা কীভাবে বাঁচব? আগে মাসে দুয়েকদিন মাংস খেতে পারতাম। এখন শুধু সবজি দিয়ে খাই।'

মতিঝিলের সালাদিয়া হোটেলের মো. হানিফ (৪৩) বলেন, 'এটা গরিবের হোটেল নামে পরিচিত। স্বল্প আয়ের মানুষই এখানে বেশি খায়, তাই দামটাও একটু কম রাখি। তবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সবকিছুর দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি।'

রাজধানীর এসব এলাকায় সিঙ্গারা, আলুর চপ, সমুচা, পেঁয়াজু, পুরিসহ ভাজাপোড়া খাবারের দাম প্রতি পিস আগের মতো ৫ টাকা থাকলেও আকার বেশ ছোট হয়ে গেছে। কোথাও আবার আকার একটু বড় করে ৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

মতিঝিল এলাকায় প্রায় ১২ বছর ধরে সিঙ্গারা বিক্রি করেন মো. রফিক (৪৫)। তার অধিকাংশ সিঙ্গারা যায় বিভিন্ন অফিসে। তিনি বলেন, 'আগে বেসন কিনতাম ৫০ টাকায়, এখন ৮০ টাকা। তেল, মরিচ, লবণ, পেঁয়াজ সবকিছুর দাম বাড়তি। তাই সিঙ্গারার সাইজ ছোট করেছি। একটি সিঙ্গারায় ৪ টাকার বেশি খরচ পড়ে।'

street-food3_ds.jpg
বনানী ১৭ নম্বর রোডে সড়কের পাশে ভাজাপোড়া খাবারের দোকান। ছবি: স্টার

দুপুর ১২টার দিকে গুলশান-১ এর ফুটপাতের একটি দোকানে বসে খাবার খাচ্ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী দীপক চন্দ্র (৪০)। নাশতা খাচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটাই নাশতা, এটাই দুপুরের খাবার। আগে সকালে নাশতা করতাম, আবার দুপুরের খাবারও খেতাম। এখন দুপুর ১২-১টার দিকে একেবারে খাই, যাতে ২ বার খেতে না হয়।'

ফুটপাতের এই দোকানেও খাবারের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। এ বিষয়ে দোকানটির মালিক মো. মন্টু মিয়া (৬০) বলেন, 'কী করব, সবকিছু কিনতেছি বেশি টাকা দিয়া। তাই বাধ্য হয়েই দামও বাড়াইছি। এখানে নিম্ন আয়ের মানুষেরাই বেশি আসেন। কিন্তু, আমারও কোনো উপায় নাই।'

রাজধানীর একটি শপিংমলের নিরাপত্তাকর্মী ইব্রাহিম মল্লিক প্লাবন (২৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেতন পাই সাড়ে ১১ হাজার টাকা। শুধু বেতন ছাড়া সব কিছুই বাড়ছে। আগে ৩ বেলা খাইতাম। এখন ২ বেলা খাই। মেসেও খাবারের খরচ বাড়ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে কী করব কিছুই জানি না।'

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দাম বেড়ে গেলে যাদের আয় কম ও নির্ধারিত, তাদের ওপরেই প্রভাব বেশি পড়ে। আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এটি কিন্তু সার্বিকভাবে খুব বেশি নয়। ইউরোপে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৮ শতাংশের বেশি। আমাদের চেয়েও ভারতে বেশি।'

তিনি বলেন, 'বাইরে দাম বাড়ার কারণে আমাদের এখানে চাপটা একটু বেড়েছে। দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হলো যেসব জিনিসের দাম বাড়ার কথা না, অসাধু কিছু ব্যবসায়ী কারসাজির মাধ্যমে সেগুলোর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার বাজার তদারকি করছে। কিন্তু লোকবলের অভাবে হয়তোবা সবসময় এই তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে অধিক মুনাফার আশায় গুদামজাত করে রাখে। এটা আমাদের চরিত্রগত সমস্যা। এসব সমস্যার কারণেই কিন্তু নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে এবং ভুক্তভোগী হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ।'

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ এখন কম খাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দাম অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় নির্দিষ্ট আয়ের মানুষসহ যারা দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ তারা একবেলা কম খাচ্ছেন বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। তারা কম খাচ্ছেন কারণ জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তাদের কিন্তু আয় বাড়েনি।'

সংকট মোকাবিলায় বাজার তদারকি আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'আগামী বাজেটে এই নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিভিন্ন ভাতা আরও বাড়াতে হবে। টিসিবি পণ্যের বিক্রি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের চরিত্র গঠনে কাজ করতে হবে।'

street-food2_ds.jpg
বনানী ১৭ নম্বর রোডে সড়কের পাশের খাবারের দোকান। ছবি: স্টার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমদের মন্ত্রীরা তো খাওয়া কমিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তাই এই অবস্থায় সাধারণ মানুষকে খাওয়া বাদ দিতে হবে।'

এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কিছু কিছু খরচ মানুষ বাদ দিতে পারবে না বা সেখানে তাদের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন: পরিবহন খরচ, বাসা ভাড়া। এখন মানুষের আয় বাড়ছে না এবং ক্রয় ক্ষমতা কমছে। যাদের আয় বাড়ছে, তারা ব্যালেন্স করতে পারবে। কিন্তু, সংখ্যাগরিষ্ঠেরই আয় বাড়ছে না। এখন শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাওয়ার খরচটা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। খাবারের দাম বাড়ায় সেটার প্রভাব পড়বে শিক্ষা ও চিকিৎসায়। যাদের আয় কম, তাদের শিশুদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। এরকম ঘটনা ঘটছেও। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী হবে মেয়েরা। তাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে ভবিষ্যতে জাতীয়ভাবে শিক্ষার হার কমবে। অল্প আয়ের মানুষ এখন চিকিৎসাটাও না নিয়ে কোনোরকমে চলবে।'

'দ্বিতীয়ত, এখন মানুষ খাবার কম খাওয়ার ফলে অপুষ্টিতে ভুগবে, অসুখে বেশি ভুগবে। আরেকটা জিনিস হতে পারে যে, কম খরচে খাওয়ার জন্যে এখন ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও বাসি খাবার বেশি বিক্রি হবে। এটাও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণ হবে। ফলে ভবিষ্যতে এর পরিণতি হিসেবে জাতীয়ভাবে মানুষের মধ্যে অপুষ্টি, অসুস্থতা দেখা যাবে', যোগ করেন তিনি।

বর্তমান অবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের কিছু করার নেই এবং তাদের ওপর দিয়েই চাপ যাবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তবে, তার মতে, চলমান অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের অনেক কিছু করার আছে। তিনি বলেন, 'প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেক ধরনের ট্রান্সফরমেশনের সুযোগ আছে। রেশনিং সিস্টেম যদি থাকত, তাহলে খাবারের ক্ষেত্রে মানুষ অন্তত ন্যূনতম সহায়তাটা পেত। টিসিবি যা দিতো, সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো দেওয়ার নিয়মটাও ভালো ছিল না। মানুষের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি তো আমাদের এখানে নেই। সেটা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।'

'বাংলাদেশে প্রত্যেকটা মানুষ অসুরক্ষিত। সরকার বা রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্ব নেই। খাবারের দাম বাড়ায় এখন শিক্ষা ও চিকিৎসায় মানুষের অ্যাক্সেস আরও কমে যাবে। অথচ সাধারণ মানুষের এসব অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। রাষ্ট্র সেটা পালন না করাতেই সংকট বেড়েছে', বলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

street-food4_ds.jpg
গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেট সড়কের পাশের খাবারের দোকান। ছবি: স্টার

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ এখন একাধিক কাজ করছে বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানুষ এখন আয়ের জন্য অন্য উৎস খুঁজছে। এভাবে তারা ব্যয় সমন্বয় করার চেষ্টা করছে। এভাবে তারা আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলেও তাদের শরীরের ওপর এক ধরনের ধকল যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি আরও ৬ মাস চলতে পারে। আগামী বছরের শুরুতে বলা যাবে যে এ পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে।'

তার মতে, চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে রেশনিংয়ের মাধ্যমে নিম্নআয়ের মানুষকে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দিতে হবে।

Comments