বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে: জাতিসংঘ
ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রেক্ষাপটে প্রথমবারের মতো সারাবিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, চলমান খাদ্য সংকট আরও অনেক মানুষকে তাদের নিজ বাসস্থান ছেড়ে পালাতে বাধ্য করবে।
আজ বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্দি আজ সাংবাদিকদের বলেন, 'ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আরও বড় সংখ্যক মানুষকে বাস্তুচ্যুত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য এ সমস্যার সমাধান অতীব গুরুত্বপূর্ণ।'
'আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন কতজন (প্রভাবিত), আমি জানি না। তবে নিঃসন্দেহে সংখ্যাটি অনেক বড় হবে', যোগ করেন ফিলিপ্পো।
ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যসরবরাহকারী দেশ। চলমান আগ্রাসনের প্রভাবে সারাবিশ্বে খাদ্যশস্য ও সারের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে খাবারের দাম আকাশ ছুঁয়েছে এবং লাখো মানুষের ক্ষুধার্ত থাকার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
ফিলিপ্পো আরও বলেন, 'যদি দ্রুত কোনো সমাধানে পৌঁছানো না যায়, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়ংকর।'
'ইতোমধ্যে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে আছে', যোগ করেন তিনি।
ইউএনএইচসিআরের বৈশ্বিক বাস্তুচ্যুতি বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ফিলিপ্পো গ্রান্দি এসব তথ্য দেন। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২১ সালের শেষের দিকে ৮ কোটি ৯৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যে সংখ্যাটি ১ দশক আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ আক্রমণের পর প্রায় ১ কোটি ১৪ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তাদের অনেকেই এখন
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন। এ ঘটনার ফলশ্রুতিতে প্রথমবারের মতো সারাবিশ্বের বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়ায়।
আশঙ্কাজনক ধারা
ফিলিপ্পো বলেন, 'গত দশকের প্রতিটি বছরই বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।'
জাতিসংঘের সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষে নতুন রেকর্ড গড়ে ২ কোটি ৭১ লাখ মানুষ শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন করছেন এবং শরণার্থী হওয়ার অপেক্ষায় আছেন আরও ৪৬ লাখ মানুষ।
ইউএনএইচসিআর আরও জানায়, একইসঙ্গে খাদ্যসামগ্রীর স্বল্পতা, মূল্যস্ফীতি ও জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের দুর্দশা বাড়াচ্ছে এবং মানবতার উদ্যোগগুলোর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। অন্যান্য সংকটের জন্য জরুরি হয়ে পড়া তহবিলের ওপরেও সৃষ্টি হয়েছে চাপ।
বাস্তুচ্যুতি সংকটের ব্যবস্থাপনা অসম্ভব নয়
ইউক্রেন সংকটে বিশ্বের বড় বড় শক্তিদের দরাজ হাতে এগিয়ে আসার বিষয়টির প্রশংসা করে ফিলিপ্পো গ্রান্দি একইসঙ্গে সিরিয়া ও আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে শরণার্থী সংকটের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রের কথাও উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান সবাইকে মনে করিয়ে দেন, কীভাবে ইউরোপের দেশের নেতারা এসব সংকটের (সিরিয়া ও আফগানিস্তান) মুহূর্তে জানিয়েছিলেন তাদের দেশে 'জায়গা নেই।'
'আমি বোকা নই। আমি পুরো প্রসঙ্গটা ধরতে পেরেছি', যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, পলায়নরত ইউক্রেনীয়দের সহায়তায় দেশগুলোর উদারভাবে এগিয়ে আসা 'একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রমাণিত করেছে, যা হলো, ধনী দেশের সীমান্তে বা সমুদ্রের তীরে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের আগমনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অসম্ভব কিছু নয়।'
ফিলিপ্পো আরও উল্লেখ করেন, ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বিপুল পরিমাণ তহবিলের জোগান দিয়েছে। কিন্তু, অন্যান্য সংকটের ক্ষেত্রে একই দেশগুলোই জানিয়েছে, তাদের রাজকোষ খালি।
'সংকটের বিপরীতে প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের অসমতার চর্চা চলতে পারে না', যোগ করেন তিনি।
কিছু দেশ দাবি করেছে, অন্যান্য দেশের জন্য প্রতিশ্রুত তহবিল অটুট রেখেই তারা ইউক্রেনের জন্য সহায়তা দিচ্ছে।
'দুষ্টচক্র'
ফিলিপ্পো গ্রান্দি সতর্ক করে বলেন, ইতোমধ্যে তহবিল সংকটে ভুগতে থাকা মানবতার উদ্যোগগুলো ভেস্তে যাবে যদি সেগুলো থেকে তহবিল অন্য খাতে সরিয়ে নেওয়া হয়।
তিনি সুনির্দিষ্টভাবে আফ্রিকার কথা উল্লেখ করেন।
'এটি বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া একটি দুষ্টচক্র', যোগ করেন তিনি।
ফিলিপ্পো বলেন, তাৎক্ষণিক প্রভাব ছাড়াও ইউক্রেনের যুদ্ধ বাস্তুচ্যুতির সমস্যায় দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। কারণ, এই যুদ্ধ 'আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর বড় আকারের আঘাত হেনেছে।'
'এই যুদ্ধের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, বিশেষত পশ্চিম ও রাশিয়ার মধ্যে যে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে, তা আগের পর্যায়ে ফিরে যেতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে', যোগ করেন তিনি।
বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, 'আর যদি পরিস্থিতির উন্নয়ন না হয়, তাহলে আমি জানি না আগামীতে আমরা বৈশ্বিক সংকটের মোকাবিলা কীভাবে করবো।'
Comments