বন্ধুত্ব-বৈরিতায় রাশিয়া ও ইরান

আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া ও ইরানকে একে অপরের ‘মিত্র’ বলে মনে হয়। তবে প্রতিবেশী দেশ ২টির সম্পর্কে বন্ধুত্বের পাশাপাশি ‘বৈরিতা’ও রয়েছে।
গত মার্চে মস্কোয় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভ ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদোল্লাহিয়ান। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া ও ইরানকে একে অপরের 'মিত্র' বলে মনে হয়। তবে প্রতিবেশী দেশ ২টির সম্পর্কে বন্ধুত্বের পাশাপাশি 'বৈরিতা'ও রয়েছে।

সম্প্রতি, তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম টিআরটি'র প্রতিবেদনে বলা হয়, মস্কো ও তেহরানের সম্পর্ক নির্ভর করে মূলত ধর্মীয়-রাজনৈতিক আদর্শ ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর।

এতে আরও বলা হয়, পশ্চিমের দেশগুলো ইরানকে রাশিয়ার 'বন্ধু' মনে করলেও তাদের বিরাজমান সম্পর্ক এত সহজ নয়, এতে বেশ 'জটিলতা' রয়েছে। দেশ ২টির সম্পর্ক মূলত যে কোনো ইস্যুতে পারস্পরিক 'সুবিধা-অসুবিধা'র ওপর নির্ভর করে। আসলে সামগ্রিক 'পরিস্থিতি'ই বলে দেয় মস্কো-তেহরানের বন্ধুত্ব বা বৈরিতা কখন কেমন হবে।

প্রতিবেদন মতে, রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের বাণিজ্য ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। বর্তমানে দেশ ২টির রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি সিরিয়ার চলমান বাস্তবতা।

রুশ-পারস্য সম্পর্কের ইতিহাস

ভৌগলিক নৈকট্যের কারণে শত শত বছর ধরে রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে চলছে। এক সময় শাহ-শাসিত পারস্য (ইরান) ও জার-শাসিত রুশ সাম্রাজ্য একে অপরের শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।

টিআরটি'র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—সাম্প্রতিক ইতিহাসেও দেখা গেছে, ইরানের শেষ সম্রাট শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির সময়ও রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে।

রাশিয়ায় জারদের পতনের পর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নও প্রতিবেশী ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছিল। কেননা, সেসময় রেজা পাহলভিকে পশ্চিমের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে গণ্য করা হতো।

তবে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পাশাপাশি ইরানের শাহ মস্কোর সঙ্গেও সখ্যতা বজায় রাখেন। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন শাহ-শাসিত প্রতিবেশী ইরানে কলকারখানা ও গ্যাসের পাইপলাইন তৈরিতে সহায়তা করে। সেসময় তারা ইরানের সামরিক বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রও দেয়।

এমনকি, ইরানের বুশেহরে পরমাণু চুল্লিও বসায় মস্কো। অর্থাৎ, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির দৃশ্যমান যাত্রা শুরু হয় রাশিয়ার হাত ধরে। বিশ্লেষকদের মতে, সেই ২ দশক ছিল মস্কো-তেহরান সম্পর্কের 'স্বর্ণযুগ।'

সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ইরানের সেই 'মধুর' সম্পর্ক হঠাৎ তিক্ত হতে শুরু করে ১৯৭৯ সালে; দেশটিতে ইসলামি বিপ্লবের পর। শাহবিরোধী আন্দোলনের সময় অনেকে ভেবেছিলেন উপসাগরীয় দেশটিতে 'সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব' ঘটতে যাচ্ছে। সেসময় ইরানে সমাজবাদীদের প্রভাবও ছিল বেশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শাহের পতনের পর ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি যুক্তরাষ্ট্রকে 'বড় শয়তান' ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে 'ছোট শয়তান' আখ্যা দেন।

বিপ্লবের বছরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন অপর প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালালে খোমেনি এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি এই আগ্রাসনকে সোভিয়েতের পতনের 'সূচনা' বলেও অভিহিত করেন। শুধু তাই নয়, খোমেনি আফগান শরণার্থীদের জন্য নিজ দেশের সীমানা খুলে দেন এবং সোভিয়েতবিরোধী সশস্ত্র মুজাহিদদের সহায়তা দেন।

তবে ১৯৮০ সালে আরব ও পশ্চিমের দেশগুলোর প্রচ্ছন্ন সহায়তায় ইরাক প্রতিবেশী ইরানে হামলা চালালে পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয়। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইরান অস্ত্রের জন্য হাত বাড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে।

সেসময় ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলগত পরিবর্তন আসে। এক সঙ্গে বিশ্বের ২ পরাশক্তির সঙ্গে শত্রুতা বজায় রাখার বদলে ইরান অপেক্ষাকৃত কম শত্রুতার দেশ তথা 'ছোট শয়তান'র সঙ্গে 'পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী' সুসম্পর্ক বজায় রাখতে শুরু করে।

'বন্ধুত্বের' ভিত্তি

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর প্রায় ২ দশক মস্কো-তেহরান সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। সে সময় নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ওপর পশ্চিমের দেশগুলোর প্রস্তাবিত অনেক নিষেধাজ্ঞায় পরাশক্তি চীনকে ভোটদানে বিরত থাকতে দেখা গেলেও এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভূমিকা ছিল পশ্চিমপন্থি।

২০১০ এর দশকে 'আরব বসন্ত'র দমকা বাতাস দামেস্কে আঘাত হানলে পরিস্থিতি হঠাৎ পাল্টাতে শুরু করে। ইরান শুরুতে আরব দেশগুলোর স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে গণজাগরণকে স্বাগত জানালেও গণতন্ত্রপন্থিরা যখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন তখন তেহরান 'ঘনিষ্ঠ বন্ধু' বাশারের পাশে দাঁড়ায়।

নিজ দেশের বাইরে রাশিয়ার একমাত্র সামরিক ঘাঁটি সিরিয়ায় থাকায় মস্কোও তেহরানের মতো পশ্চিম-সমর্থিত গণতন্ত্রপন্থিদের রোষ থেকে বাশারকে রক্ষায় এগিয়ে আসে। সিরিয়ার মাটিতে রাশিয়া-ইরানের বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।

বন্ধুত্বের পাশাপাশি বৈরিতা

সিরিয়ার চলমান ঘটনায় মস্কো-তেহরান প্রায়শই এক সুরে কথা বললেও সিরিয়ার চৌহদ্দির বাইরের দেশ ২টির মধ্যে এখনও বৈরিতা টিকে আছে। বিশেষ করে, ককেশীয় অঞ্চল ও মধ্য এশিয়ায় সাবেক সোভিয়েতভুক্ত প্রজাতন্ত্রগুলোয় দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে ইরান।

টিআরটি জানায়, গত বছর ককেশীয় অঞ্চলে আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর সে অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায় ইরান। যুদ্ধচলাকালে ইরেভান সরকার মস্কো থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন না পাওয়ায় তারা 'ঐতিহাসিক বন্ধু' ইরানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

অপরদিকে, আজারবাইজানের সঙ্গে ইসরায়েলের 'সুসম্পর্কের' অভিযোগ তুলে বাকুকে চাপে রাখার নীতি গ্রহণ করেছে ইরান। যা প্রকারান্তরে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্মেনিয়ার জন্য।

এ ছাড়াও, মধ্য এশিয়ায় তাজিকিস্তানের নিরাপত্তা ইস্যুতে মস্কোর সঙ্গে বৈরিতা তৈরি হয়েছে তেহরানের। ইতোমধ্যে, দুশানবেতে নিজেদের তৈরি ড্রোন উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে তেহরান।

ককেশীয় অঞ্চল ও মধ্য এশিয়ার ভূবেষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ইরান সেসব দেশের পণ্য অন্য দেশে পাঠাতে ট্রানজিট সহায়তা বাড়িয়ে দেয়।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ফলে সেসব অঞ্চলের দেশ 'নিরাপত্তাহীনতা'য় ভোগায় এখন তারা ইরানকে 'আস্থা'র স্থল ভাবছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Gaza still bleeding

Death toll nears 42,000; rallies worldwide calls for ceasefire

1h ago