মুক্তিযুদ্ধে বরগুনা গণহত্যা

‘আমার ভাই নাসির তখনও জীবিত। সে বলল, ‘‘ফারুক, তুই আছিস?’’ আমি বললাম ‘‘আছি’’।
বরগুনা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

'আমার ভাই নাসির তখনও জীবিত। সে বলল, ''ফারুক, তুই আছিস?'' আমি বললাম ''আছি''।

''তর গায়ে গুলি লাগে নাই?'' আমি বললাম, ''না''।

''লাগছে, তর গায়ে গুলি লাগছে। ভালা কইরা দেখ।'

''না, লাগেনি।''

এরপর ভাই বলল, ''আমারে পানি খাওয়াইতে পারিস?''

আমি তখন পানি পাই কোথায়! বৃষ্টি হচ্ছে, চারদিকে খালি মরদেহ আর রক্ত। ২ হাতে বৃষ্টির পানি নেওয়ার চেষ্টা করলাম, পারলাম না।

ভাই তখন বলল, ''পেট তো ছিঁড়ে গেছে আমার। কাজ হইবে না আর। তুই মায়রে দেইখা রাখিস। আমি মৃত্যুর সময় পানি পাইলাম না। তরে আল্লায় হয়তো ফিরাইবার পারে। আমার চিন্তা করিস না।''

একটু পর বিহারী ইমাম উদ্দিনসহ এক রাজাকার ১০-১৫ জন লোক নিয়ে আসেন সব মরদেহ সরিয়ে নেওয়ার জন্য। ইমাম উদ্দিন আমাকে দেখে বললেন, ''তুই এখনও বাঁইচা আছস?''

তখন তিনি পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে আমার জীবিত থাকার কথা বললে ওরাও ভীষণ আশ্চর্য হলো। ওইদিন ৩ বার গুলি করল ওরা আমাকে। সব আমার কানের পাশ দিয়ে ও বাহুর নিচে দিয়ে গেল। একটাও লাগেনি। পরদিন আবার গুলি করেছে ২ বার। ওইগুলোও লাগেনি। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন শেষে বিরক্ত হয়ে উর্দুতে বললেন, 'তোমহারা পাস তাবিজ হ্যায়?'

আমার এক ভাই নাসির উদ্দিন তো আমার সামনেই শহীদ হলো। আরেক ভাই মোশাররফ হোসেন সানুকে প্রথম দিনই পাকিস্তানি মেজর নাদির পারভেজ গানবোটে করে পটুয়াখালী নিয়ে গেল। গণহত্যার ২৮ দিন পর আমার মা আমাকে ছাড়িয়ে আনলেন।'

কথাগুলো বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ফারুকুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধে বরগুনা জেলহত্যার ঘটনায় জীবিত একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। ২০ মে ওয়্যারলেস স্টেশন ধ্বংস করতে গিয়ে ২ ভাই সহ ধরা পড়েছিলেন ফারুকুল ইসলাম। গণহত্যার ২ দিনে ৫ বার তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা সত্ত্বেও বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।

গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা ফারুকুল ইসলাম। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

৫১ বছর পর আজও চোখ বুজলেই তার চোখে ভেসে উঠে সেই ভয়াল দৃশ্য। শুনতে পান তার মুমূর্ষু তৃষ্ণার্ত ভাইয়ের পানি চাওয়ার আকুল আবেদন।

২৯ ও ৩০ মে ২ দিনব্যাপী বরগুনা কারাগারে এই গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।

২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী পটুয়াখালী শহর দখল করে। এরপর পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন পটুয়াখালীর সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ দেয় ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর রাজা নাদির পারভেজ খানকে।

১৪ মে পাকিস্তানি বাহিনী বড় একটি গানবোটে করে গিয়ে বরগুনা শহরের দখল নেয়। এরপর ১৫ মে মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী বরগুনার পাথরঘাটার বিষখালী নদীর তীরে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন কয়েকশ নিরীহ সাধারণ মানুষ। বিষখালী নদী যেন পরিণত হয় রক্তের নদীতে।

এরপর সেখান থেকেই কিছু বাসিন্দাকে বন্দী করে বরগুনা শহরে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। পরে তাদের বরগুনা মহকুমা কারাগারে বন্দী করে পাকিস্তানি বাহিনী বরগুনা ছেড়ে পটুয়াখালী ফিরে যায়।

পাকিস্তানি বাহিনী বরগুনা ছাড়ার পর স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যরা ঘোষণা করে, হিন্দুরা চাইলেই বরগুনা শহরে আসতে পারবেন। এমন ঘোষণার পর বহু বাঙালি হিন্দু বরগুনাতে নিজেদের বাড়িতে ফিরে যান।

কিন্তু ২৬ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন শাফায়াতের নেতৃত্বে ৪ জন পাকিস্তানি সেনা স্পিডবোটে গোপনে বরগুনায় যান। ওইদিন রাতেই স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন ক্যাপ্টেন শাফায়াত। ২৭ মে ক্যাপ্টেন শাফায়াতের নেতৃত্বে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা সিদ্ধান্ত নেয়, ভোর হতেই যৌথভাবে অপারেশন শুরু করবে হানাদার ও রাজাকাররা।

২৭ মে ভোর থেকেই যৌথভাবে অপারেশন শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার সেনা ও রাজাকাররা। এ সময় বিপুল সংখ্যক নিরীহ নারী-পুরুষ প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা এ সময় ঘেরাও দিয়ে রাজাকারদের সহযোগিতায় বহু মানুষকে বেঁধে বরগুনা কারাগারে নিয়ে বন্দী করে। ২৭ মে এবং ২৮ মে পটুয়াখালী জেলা সামরিক প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজের নির্দেশে শতাধিক তরুণ এবং ৮০-৯০ জনের মতো নারীকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করে বরগুনা কারাগারে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী।

২৮ মে নাদের পারভেজ পটুয়াখালী থেকে বরগুনা শহরে যান। ওইদিন রাতেই বরগুনা থানার ওসি আনোয়ার হোসেন, বরগুনার মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজিজ মাস্টারসহ শান্তি কমিটি ও রাজাকার কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন মেজর নাদির পারভেজ। বৈঠকে ঠিক করা হয়, ২৯ মে বরগুনা কারাগারের অভ্যন্তরে চালানো হবে এই হত্যাকাণ্ড। সেদিন বরগুনা গণপূর্ত অধিদপ্তরের ডাক বাংলোতে ধরে আনা নারীদের ধর্ষণ করে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকাররা।

বরগুনা জেলখানার উত্তর পাশে ছিল বরগুনা হাইস্কুল। ২৯ মে সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর নাদের পারভেজের সঙ্গে আনুমানিক ১০০ পাকিস্তানি সেনা ঢুকল বরগুনা কারাগারে।

এরপর কী হলো, জানা গেল প্রত্যক্ষদর্শী ফারুকুল ইসলামের বর্ণনায়।

ফারুকুল ইসলাম বলেন, 'মোট ৩ ওয়ার্ডে প্রায় ১০০ জনের মতো হিন্দু পুরুষ বন্দী ছিলেন। মুসলিম ছিলাম শুধু আমরা ৩ ভাই। আমরা ছিলাম আলাদা ওয়ার্ডে। তারা সবাইকে ওয়ার্ড থেকে বের করে সেলের সামনে এনে লাইনে দাঁড় করাল। বরগুনা থানার ওসি আনোয়ার হোসেন মেজর নাদের পারভেজ আমাদের ৩ ভাইকে দেখিয়ে উর্দুতে বললেন, ''স্যার, এই ৩ জন মুক্তি। ওদের ধরে এনেছি।''

তখন আমাদের সেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর বাইরে গুলি শুরু হয়ে গেছে। গুলি যখন শুরু হলো, তখন আনুমানিক সময় সকাল সাড়ে ১০টা হবে। এরপর দেড় ঘণ্টা ধরে একটানা গুলি চলল।

ঘণ্টা দেড়েকের ব্যবধানেই বরগুনা কারাগার ভেসে গেল রক্তের বন্যায়। সেদিন বিকেল ৪টা নাগাদ শহীদ হলেন লক্ষণ দাস নামের এক বন্দী। রাতে হার্টফেল করে মারা গেলেন লক্ষণ দাসের এক ছেলে। এ ছাড়া, সেদিন গুলিতে গুরুতর আহত পল্লী চিকিৎসক কেষ্টু ডাক্তার গণহত্যা শেষে পালাতে গিয়ে এক রাজাকারের কোদালের আঘাতে শহীদ হন।'

 'প্রথমদিনের এই গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন মোট ৪০ জন বন্দী', বলেন ফারুকুল ইসলাম।

মেজর রাজা নাদির পারভেজ খান। ছবি: সংগৃহীত

গণহত্যার এক পর্যায়ে মেজর নাদের পারভেজ পটুয়াখালী ফিরে যান। সঙ্গে ধরে নিয়ে যান ওয়্যারলেস স্টেশন ধ্বংস করতে গিয়ে ধরা পড়া মোশাররফ হোসেন সানুকে। পরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, তাকে হয়তো বিষখালী নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করেছে হানাদার সেনারা।

প্রথম দিন নির্বিচারে গণহত্যা চালালেও গণহত্যার দ্বিতীয় দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ছিল খানিকটা সতর্ক। ২৯ মে গণহত্যার রাতে আনুমানিক ৩০ জনের মতো বন্দী ছিলেন বরগুনা কারাগারে। সেদিন রাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য গরু-বাছুর লুট করে এনেও বরগুনা কারাগারের ভেতর রেখেছিল রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা।

৩০ মে ১৯৭১, গণহত্যার দ্বিতীয় দিন

৩০ মে ছিল বরগুনা কারাগার গণহত্যার দ্বিতীয় দিন। এদিন সকাল ১১টা- সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন শাফায়াতের নির্দেশে বন্দীদের বিচারের জন্য আদালত বসাল পাকিস্তানি সেনারা। ৩টি ওয়ার্ডে থাকা বন্দীদের বের করা হলো। ধোপা, নাপিত ও কামার পেশার লোকদের আলাদা করা হলো।

দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা বাকিদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করল। যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন, তাদের কয়েকজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও কোদাল ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে হানাদাররা।'

এরপর পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের সামনে আনা হয় আগের দিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া ফারুকুল ইসলামকে।

ফারুকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাকে টমিগানের সামনে নিয়ে গেল ওরা। এরপর ক্যাপ্টেন গুলি করার আদেশ দিলেন। একটা গুলি গেল আমার বাম কানের পাশ দিয়ে। কিন্তু লাগল না। তখন আর্মির সেই ক্যাপ্টেন রেগে গিয়ে বললেন, 'শুট এগেইন'। গুলিটা এবার আমার মাথার ডানপাশ দিয়ে চলে গেল। এটাও লাগল না। তখন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আমাকে জিজ্ঞেস করল, ''তোমহারা পাস তাবিজ হ্যায়?''(তোমার কাছে তাবিজ আছে?) কিন্তু ওরা পুরো শরীর তল্লাশি করেও কোন তাবিজ পেল না। তার ২৮ দিন পর আমি ছাড়া পেলাম।'

ফারুকুল ইসলামের বলেন, 'দ্বিতীয় দিনে চালানো গণহত্যায় শহীদ হন ১৭ জন নিরীহ সাধারণ মানুষ।'

বরগুনা জেল গণহত্যার জীবিত একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ফারুকুল ইসলামের হিসেব মতে, '২ দিনব্যাপী চালানো এই জেলহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন ৫৭ জন বন্দী।'

তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস: সেক্টর ৯ এ বরগুনা জেলহত্যায় শহীদের সংখ্যা উল্লেখ আছে ৯১ জন।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস: সেক্টর ৯

[email protected] 

 

 

Comments