সেলিনা হোসেনের ‘আগস্টের একরাত’

একাত্তরের পর বাঙালির জীবনে বেদনা-বিধুর ও বিভীষিকাময় মাস ১৯৭৫ সালের আগস্ট। নিদারুণ বাস্তবতায় মানবতা ডুকরে কেঁদেছিল সেসময়। বিশ্বাসঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করে। পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায়ও লিপ্ত হয় হায়েনারা। এতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়।

ইতিহাস বলে এসব হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা পরবর্তী সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা এবং আশীর্বাদ পেয়েছে। কালক্রমে ভয়ানক সশস্ত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হয়। যারা নৃশংসতা চালিয়েছে, তারাই আবার বীর-দর্পে ক্ষমতায় ছিল। এই নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সমাজে।

কিন্তু কেউই প্রকাশ করেন না, সাহস পান না। কিছুটা ধারণ করেন সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষরা। অব্যক্ত যন্ত্রণা লিপিবদ্ধ করেন কবি-সাহিত্যিকরা। তাদের মধ্যে অন্যতম কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

বঙ্গবন্ধু নিয়ে রচনা করেন উপন্যাস 'আগস্টের একরাত'। নির্মম ঘটনা নিয়ে রচিত উপন্যাসটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে সৃষ্টি। তবে, এর প্রতিটি চরিত্রই মৃত। তারা ঘিরে আছেন এমন একজনকে, যাকে ছাড়া আমাদের আত্মপরিচয় অস্পষ্ট, বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মাণ হতো না।

বইটি পড়ে বুঝা গেল, লেখক বহুপথ হেঁটেছেন, ঘেঁটেছেন ঘরে বাইরের নানা তথ্য-উপাত্ত। যুক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৬১ জন সাক্ষীর বয়ান। ফলে এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে চেনা হবে নতুনভাবে।

এর আগেও সেলিনা হোসেন ইতিহাস এবং রাজনীতি নির্ভর উপন্যাস রচনা করেছেন। যেগুলোতে জীবন ও সমাজ বাস্তবতার যোগসূত্রতা পান পাঠক। তার সাহিত্য 'জীবন যেখানে যেমন'র উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচনা করেন 'যাপিত জীবন' এবং 'নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি'। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার 'হাঙ্গর নদী গ্রেনেড', 'গায়ত্রী সন্ধ্যা', 'ত্রয়ী', 'কাকতাড়ুয়া'সহ চারটি উপন্যাস।

এইভাবে বাস্তব জীবন, উপন্যাসের মাধ্যমে জনগণের জাগরণকেই দেখিয়েছেন কথকের ভাষায়। 'হাঙর নদী গ্রেনেড' তার প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এটি নিয়ে সিনেমাও নির্মিত হয়েছে।

সেলিনা হোসেন বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার লেখাগুলো ঠিক উপন্যাস নয়, ইতিহাস। এগুলো নারীর সাহস, শক্তি, মর্যাদাবোধের ইতিহাস। তখন আমাদের অনেক মা-ই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়তো অতটা শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু স্বাধীনতা সম্পর্কে দিনে দিনে তৈরি হয়েছিল তাদের সচেতনতা।'

ইতিহাস এবং বাস্তব জীবনের পরতে পরতে যে মায়াবী জীবন, সংগ্রাম, উষ্ণতা, প্রেম, বিরহ, বেদনা ও স্বপ্ন, তার উপন্যাসে তুলে এনেছেন দক্ষতায়। তার এই মৌলিকত্ব সত্যি অনন্য।

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, 'ইতিহাসের গভীরে সন্ধানী আলো ফেলে ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন সৃষ্টিতে তার সৃষ্টি কিংবদন্তীতুল্য। বস্তুত ইতিহাসের আধারেই তিনি সন্ধান করেন বর্তমানকে। শিল্পিত করেন নানা মাত্রিক শিল্প-উপকরণ।

সমকালীন জীবন ও সংগ্রামকে সাহিত্যের শব্দ স্রোতে ধারণ করাই সেলিনা হোসেনের শিল্প অভিযাত্রার মৌল অম্বিষ্ট। এ ক্ষেত্রে শ্রেণি অবস্থান এবং শ্রেণি সংগ্রাম চেতনা প্রায়শই শিল্পিতা পায় তার ঔপন্যাসিক বয়ানে, তার শিল্প আখ্যানে। কেবল শ্রেণি চেতনা নয়, ঐতিহ্য স্মরণও তার কথাসাহিত্যের একটি সাধারণ লক্ষণ।'

কীভাবে, কখন 'আগস্টের এক রাত' উপন্যাসটি রচিত হলো। সেলিনা হোসেনের কলমেই জানা যাক, '২০০৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। একটি অনুষ্ঠানে আমার দেখা হয়েছিল অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাহেবের সঙ্গে। তিনি কাছে এসে বললেন, আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে। একটি উপন্যাস লেখার জন্য কিছু উপাদান আমি আপনাকে দিতে চাই। আপনি সময় করে হাইকোর্টে আমার অফিসে আসবেন।'

'কিছুদিন পর অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেবের অফিসে গেলাম। আমাকে দেখে তিনি তার লোককে বললেন, ওনার জন্য যে ফাইলটা রেখেছি ওটা নিয়ে এসো। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে একটি বড়সড় ফাইল নিয়ে এলো। তিনি বললেন, এই ফাইলটি হলো বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দি। ১৫ আগস্ট রাতে কী ঘটেছিল তার বিবরণ।'

'ফাইলের ওপরে লেখা আছে Additional Paper Books of Death Reference No. 30 of 1998 বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট In the Supreme Court of Bangladesh আপিল বিভাগ (Appeallate Division)। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৯৫। সেখানে ৬১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি। পুরো ফাইল পড়তে যেমন সময় লেগেছে, তেমনই চোখ জলে ভরেছে। পড়তে কষ্ট হয়েছে। চোখ মুছে শেষ করতে পারতাম না। তারপর একদিন লেখার কাজ শুরু করি।'

'শুরু করেছি এভাবে: রাতের শেষ প্রহর। বাইরে প্রবল গুলির শব্দ। চৌচির হয়ে ফেটে যাচ্ছে দিনের প্রথম প্রহর।'

'সাক্ষীদের জবানবন্দি ব্যবহার করেছি একটি অধ্যায়ে। অন্য অধ্যায়ে আছে মৃত মানুষদের চালচলন। এভাবে উপন্যাস এগিয়েছে। পরে একজন সাক্ষীর জবানবন্দিতে সে রাতের ঘটনা এভাবে উঠে এসেছে: আমি হাবিলদার মো. কুদ্দুস সিকদার ও কয়েকজন এনসিও সিপাহিসহ ২৫ জনের একটি দলকে ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর রোডে ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে অর্থাৎ তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ডিউটিতে পাঠায়।...'

'এই সময় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণে লেকের দিক হইতে লাগাতার গুলি আসিতে থাকে। তখন আমি এবং আমার গার্ডসহ দেয়ালের আড়ালে লাইন পজিশনে যাই। গুলি বন্ধ হওয়ার পর পাল্টা গুলি করার জন্য আমার পূর্ববর্তী গার্ড কমান্ডারের নিকট গুলি খোঁজাখুঁজি করিতে থাকি।'

'এ সময় কালো ও খাকি পোশাকধারী সৈনিক হ্যান্ডস আপ বলিতে বলিতে গেটের মধ্য দিয়ে বাড়িতে ঢুকে। তখন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বারান্দায় আসিয়া সেখানে কামালকে দাঁড়ানো দেখিয়াই ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা হাতের স্টেনগান দ্বারা শেখ কামালকে গুলি করে। শেখ কামাল গুলি খাইয়া রিসিপশন রুমে পড়িয়া যায়। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা পুনরায় শেখ কামালকে গুলি করিয়া হত্যা করে।'

'ইহার পর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর বাড়ির পুলিশের ও কাজের লোকদেরকে গেইটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। ইহার পর মেজর মহিউদ্দিন তাহার ল্যান্সারের ফোর্স লইয়া গুলি করিতে করিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দোতলার দিকে যায়। তারপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর কয়েকজন ফোর্স লইয়া বাড়ির বারান্দা দিয়া দোতলার দিকে যায়।'

'এই সময় আমাদেরকে তাহাদের সাথে যাইতে হুকুম দিলে আমি তাহাদের পিছনে পিছনে যাই। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর সিঁড়ি দিয়া চৌকির (slap) উপরে গেলে মেজর মহিউদ্দিন ও তাহার সঙ্গীয় ফোর্সকে বঙ্গবন্ধুকে নিচের দিকে নামাইয়া আনিতে দেখি। আমি ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূরের পিছনে দাঁড়ানো ছিলাম। এই সময় মেজর নূর ইংরেজিতে কী যেন বলিলেন।'

'তখন মহিউদ্দিন ও তাহার ফোর্স এক পাশে চলিয়া যায়। এই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তোরা কী চাস? এরপরই ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর হাতের স্টেনগান দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির মধ্যে পড়িয়া মৃত্যুবরণ করেন। তখন বঙ্গবন্ধুর পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, একহাতে সিগারেটের পাইপ, অন্য হাতে দিয়াশলাই ছিল। অতঃপর মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদাসহ সবাই নিচে নামিয়ে আসিয়া দক্ষিণ দিকে গেইটের বাহিরের রাস্তায় চলিয়া যায়।'

'কিছুক্ষণ পরে মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেউদ্দিন ও ল্যান্সারের ফোর্স এবং টু-ফিল্ড আর্টিলারির ফোর্স গেইটের সামনে আসে। তারপর মেজর আজিজ পাশা তাহার ফোর্স লইয়া গেইটের মধ্যে দিয়া বাড়ির দোতলার দিকে যাইতে থাকে। আমিও তাহাদের পিছনে পিছনে যাই।...'

'তারপর মেজর আজিজ পাশা তার ফোর্সসহ দোতলায় বঙ্গবন্ধুর রুমের দরজা খোলার জন্য বলে। দরজা না খুলিলে দরজায় গুলি করে। তখন বেগম মুজিব দরজা খুলিয়া দেন।...'

'একদল ফোর্স রুম হইতে বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও একজন বাড়ির চাকরকে রুম হইতে বাহির করিয়া নিয়া আসে। বেগম মুজিব সিঁড়ির নিকট আসিয়া শেখ মুজিবের লাশ দেখিয়া কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন।'

পরের অধ্যায় আমি এভাবে লিখি:

'বঙ্গবন্ধু এখন মরদেহ। ভূখণ্ডের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শরীরটির নান্দনিক শিল্প এখন আশ্চর্য নীরবতায় মহাকালের খেরোখাতায় ভরে ওঠার জন্য অপেক্ষমাণ। নিথর শরীরও যে কত বাঙ্ময় হতে পারে ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে শায়িত তাকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। প্রাণস্পন্দনে কল্লোলহীন শরীর থেকে প্রবাহিত হচ্ছে রক্ত।'

পাঠককে উপন্যাসের পাতায় পাতায় মোহগ্রস্ত করে রাখবে। বলা যায় সেলিনা হোসেন আপাদমস্তক কথাসাহিত্যিক। তার লেখায় ব্যবহার হয়েছে ঐতিহাসিক উপাদান। সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় রেখেছেন প্রাতিস্বিক প্রতিভার স্বাক্ষর।

উপন্যাসে রাজনৈতিক সময়, আন্দোলন, নারীর শাশ্বত দৃষ্টি উঠে এসেছে। একইসঙ্গে নিজস্ব ঐতিহ্য, জনকের অবদান মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম, ত্যাগ যাতনা উপস্থাপিত হয়েছে অসামান্য দরদে।

Comments

The Daily Star  | English

Why are onion prices rising abruptly?

Onion prices have been increasing over the past weeks, as farmers and traders release fewer stocks to local markets in the hope of better returns amid the government’s suspension of imports

1h ago