‘হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আড্ডা ছিল উপন্যাসের চেয়েও আনন্দের’

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক ছিল জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের। জাদুর প্রতি প্রবল ভালোবাসা ছিল খ্যাতিমান এই লেখকের। অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও উপন্যাসের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিল জুয়েল আইচের।
দ্য ডেইলি স্টারের কাছে দুজনের বন্ধুত্বের গল্প বলেছেন জুয়েল আইচ।
'হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। একটার পর একটা গল্প মনে আসতেই থাকবে। কত দিন কিংবা রাতের সুখ স্মৃতি আমাদের। কয়েক দশকের মধুর সম্পর্কে একটু একটু করে অসংখ্য স্মৃতি জমে আছে জীবন খাতায়।
তার সঙ্গে আমার রুচির খুব মিল ছিল। সেটা নানান বিষয়ে। বিশেষ করে খাওয়ার রুচির দারুণ মিল ছিল। দুজনেই একইরকম খাবার খেতে পছন্দ করতাম। কম তেল দিয়ে তরকারি রান্না পছন্দ করতাম দুজনেই। কতদিন একসঙ্গে খেয়েছি তার হিসেবে নেই। হৃদয়ের নীল আকাশে নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে সেইসব মুহূর্তগুলো।
মনে পড়ে-ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় যাবেন। তার বাসায় গেলাম। এমনভাবে মজা করা শুরু করলেন—কেউ ভাবতেই পারছিলাম না তিনি কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। খুব হাসাহাসিও করেছিলেন ওই অবস্থায়। মজার মজার গল্প করছিলেন। এটাই হুমায়ূন আহমেদ। এটাই তার জাদু। এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। ওইদিন না খেয়ে চলে আসব। সেই সময় আমার হাত ধরে ফেললেন। খাওয়ার টেবিলে বসালেন। একসঙ্গে খেলাম দুজনে। খাওয়া শেষে তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন একটি ছবি নিয়ে আসেন। হুমায়ূন আহমেদের আঁকা। ছবি দেখে থমকে যাই। কী এঁকেছেন এটা? সাদা মেঘের আড়াল থেকে কালো মেঘ ভেসে চলেছে। নৌকা আছে নিচে। নদীর ওপার নৌকা চলে গেছে। ছবি দেখে ভেবেছিলাম-তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন আর ফিরবেন না? আমি আনমনা হয়ে যাই। চোখে জল আসার মতো অবস্থা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ সবকিছু সহজ করে নিয়ে ফের আনন্দের গল্প বলা শুরু করেন।

ক্যান্সার চিকিৎসা শেষে হুমায়ূন আহমেদ দেশে ফিরেছেন। ওই ছিল শেষ ফেরা জীবদ্দশায়। মিরপুরে তার ছোট ভাই আহসান হাবীবের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। আমিও গিয়েছি নিমন্ত্রণ খেতে। খাওয়া শেষে হুমায়ূন আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে আসেন। দেয়ালের ভেতরের একটি জায়গায় কুয়ার কাছে বাধাই করা জায়গায় বসি দুজনে।
তারপর তিনি আমার হাত ধরলেন। চোখ ভেজা তার। আমিও কিছু বুঝতে পারছি না কি বলবেন? কি বা হয়েছে? আমি তাকালাম তার চোখে। তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন। আস্তে করে বললেন, জুয়েল, আমার চরম শত্রুরও যেন এই অসুখ না হয়। এত কষ্ট এই অসুখের, সহ্য করা যায় না। আমার চোখ ভিজে এসেছিল কথাটি শুনে।
হুমায়ূন আহমেদের কিরকম কঠিন রাগ ছিল তার একটি উদাহরণ দিই। তখন তিনি শহীদুল্লাহ হলের ওখানে কোয়ার্টারে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এক দুপুর শেষে তার বাসায় হাজির হই। সেদিন দুপুরে আমি খাইনি। তিনিও খাননি।
দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি ঘটনা বলি তাকে। ঘটনাটি শোনার পর শার্ট গায়ে দিলেন। প্যান্ট পরলেন। আমি বললাম, খেয়ে নিন হুমায়ূন ভাই। তিনি বললেন, না খাব না। খেলে রাগ পড়ে যাবে।
আমার গাড়িতে উঠি তাকে নিয়ে। গাড়িতে বসে চুল টানতে লাগলেন। বললাম, কী করছেন? কী করছেন? চুল ছিঁড়ে যাবে তো।
তিনি বলেন, ছিঁড়ুক। কঠিন রাগ উঠানোর এটাই ওষুধ।
কিছুদূর যাবার পর শার্টের বোতাম ছিঁড়ে ফেললেন। আমি ভয়ে বললাম, আরে এ-কি করছেন হুমায়ূন ভাই? আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, রাগ উঠাতে দিন। কঠিন রাগ কাকে বলে আজ দেখাব।
এরপর বিটিভিতে যাই। সরাসরি নওয়াজীশ আলী খানের রুমে। এই মানুষটি আমার খুব পছন্দের। রুমে ঢুকেই হুমায়ূন আহমেদ বললেন, নওয়াজীশ ভাই আপনি এটা কী করছেন? জুয়েল আইচ দেখাবে জাদু? তাকে আপনি অনুষ্ঠান করার কথা কেন বলছেন?
নওয়াজীশ আলী খান সব বুঝতে পারেন। শান্ত হতে বলেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের রাগ কি সহজে কমে!
শেষে নওয়াজীশ আলী খান সমাধান দিলেন। অনুষ্ঠানের নাম হলো—আনন্দমেলা জুয়েলের জাদুর জগত।
এভাবেই তার রাগ কমানো গিয়েছিল। এই ছিল কথার জাদুকরের জীবন। এই রাগ এই সরলতা। হুমায়ূন আহমেদের ভেতরটা ছিল শিশুর মতো সরল।
আড্ডার স্মৃতি বলি। একজীবনে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কত আড্ডা দিয়েছি তার গল্প সিনেমা বা নাটককেও হার মানাবে। অসম্ভব আড্ডাবাজ ছিলেন। আড্ডা দিতে ও আনন্দে মেতে থাকতে পছন্দ করতেন।
দখিন হাওয়ায় খুব আড্ডা দিতাম একসময়। অন্যান্য বাসায়ও আড্ডা দিয়েছি। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আড্ডা উপন্যাসের চেয়েও আনন্দের ছিল।
আড্ডায় তিনি একেকদিন একেকজনকে টার্গেট করতেন। যাকে নিয়ে হাসাহাসি করা যেত। তবে আমাকে কোনোদিন টার্গেট করেননি। আড্ডা শেষে ভোজন বিলাসও হতো।
হুমায়ূন আহমেদ ও আমার সম্পর্কের শুরু বহু বছর আগে। তার শেষ জীবন পর্যন্ত এই মধুর সম্পর্ক ছিল। তার নাটক, সিনেমা ও উপন্যাসের প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল আকাশছোঁয়া। আজও আছে। যতদিন বাঁচব এটা থাকবে।
হুমায়ূন আহমেদ একটি কথা খুব জোর দিয়ে বলতেন, তা হচ্ছে—আমি সিনেমা শুরু করেছি জুয়েল আইচের অনুপ্রেরণায়। এই কথাটি আজও কানে বাজে।
তার সব লেখা আমি পড়েছি। কোনো কোনো বই দুই বারও পড়েছি। প্রথম তিনটি বই খুব পছন্দের। 'নন্দিত নরকে', 'শঙ্খনীল কারাগার' ও 'তোমাদের জন্য ভালোবাসা'। 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসের কথা না বললেই নয়। কী আবেগ দিয়ে লেখা।
তার নাটক মানেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান। এখনো আছে সেইসব নাটকের জনপ্রিয়তা। আমার কাছে তার সব নাটকই প্রিয়। সবচেয়ে প্রিয় 'কোথাও কেউ নেই'। এটা অবশ্য বাকের ভাইয়ের জন্য।'
Comments