ডার্বির ওমর খৈয়াম ও কবিদের ঘোড়া বৃত্তান্ত

হাজার বছর আগে পারস্যের নিশাবুরে জন্ম নেওয়া ওমর খৈয়াম জগৎজুড়ে কবি হিসেবে খ্যাত। একজন গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক হিসেবেও তিনি সমাধিক পরিচিত। তিনি দর্শনের পাঠ তৈরি করে গেছেন কবিতার মধ্য দিয়ে।
ডার্বিজয়ী প্রথম বিদেশি ঘোড়া ওমর খৈয়াম। ছবি: সংগৃহীত

হাজার বছর আগে পারস্যের নিশাবুরে জন্ম নেওয়া ওমর খৈয়াম জগৎজুড়ে কবি হিসেবে খ্যাত। একজন গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক হিসেবেও তিনি সমাধিক পরিচিত। তিনি দর্শনের পাঠ তৈরি করে গেছেন কবিতার মধ্য দিয়ে।

ওমর খৈয়াম তার দর্শনের ভাবনা লিখেছিলেন রুবাই ধরনে। একবচনে রুবাই, বহুবচনে রুবাইয়াত। মানে চতুষ্পদী। তার রচিত রুবাই ঘোড়ার ক্ষিপ্রতা ও গতির ছন্দে সমাদৃত হয়েছে বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয়ে। 

ওমর খৈয়ামের জন্মের ৮৬৬ বছর পর জন্ম নেয় আরেক ওমর খৈয়াম! ১৮৭৫ সাল থেকে চলে আসা বিখ্যাত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা কেন্টাকি ডার্বিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বখ্যাত হয় এই ঘোড়াটি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে ১৯১৪ সালে ব্রিটেনে স্যার জন রবিনসনের অশ্বশালায় জন্ম নেওয়া এই সুদর্শন অশ্বশাবকটির নাম রাখা হয় খৈয়ামের নামে। এর মা লিসমা এপসন ডার্বিশায়ার রেস চ্যাম্পিয়ন পার্সিমনের কন্যা। খৈয়ামের বাবাও বিখ্যাত রেস হর্স মার্কো। ইউরোপে প্রথম মহাযুদ্ধের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে বিশিষ্ট ঘোড়াপ্রেমিকদের অনেকেই তাদের ঘোড়াটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যান। 

১ বছর বয়সী ওমর খৈয়ামকে নিলামে তোলা হয় ১৯১৫ সালে। দেড় হাজার ডলার দিয়ে একে কিনে নেন আমেরিকান হর্স ট্রেইনার চার্লস টি প্যাটারসন। ১৯১৭ সালে ৩ বছর বয়সে ওমর খৈয়ামকে কেন্টাকি ডার্বিতে নামালে শুরুতে এটি তেমন নজর কাড়েনি। সে বছরের হট ফেভারিট ছিল টিকেট নামের ঘোড়াটি। প্রায় সকলেই টিকেটকে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত দৌড়ে অংশ নেওয়া ১৫টি ঘোড়ার মধ্যে সবার আগে ছুটতে থাকা টিকেটকে আচমকা পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় ওমর খৈয়াম। 

ওমর খৈয়ামই ডার্বি চ্যাম্পিয়ন হওয়া প্রথম বিদেশি ঘোড়া। তার জকি ছিলেন চার্লস বোরেন। দেড় হাজার ডলারে কেনা ওপর খৈয়াম কেবল ডার্বি জিতেই মালিককে ফিরিয়ে ছিলেন ১৬ হাজার ডলার। পরের বছর ওমর খৈয়াম ২৬ হাজার ডলারে বিক্রি হয়ে যায়। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৮ সাল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভার্জিনিয়ার শার্লটভাইল আস্তাবলে থাকে খৈয়াম।

ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথের ঘোড়ার জন্মের ইতিহাস

সৃষ্টির সকল কাজ যখন শেষ হয় হয় অবস্থা তখন ব্রহ্মার সৃজনশীল মাথায় সৃষ্টির নতুন এক উন্মাদনা শুরু হলো। তিনি ভাণ্ডারীকে মালামাল যোগাড় করতে বললেন। করজোড় ভাণ্ডারী জানিয়ে দিলেন হাতি, তিমি, অজগর, সিংহ, বাঘ সৃষ্টির সময় পঞ্চভূতের প্রায় সকল উপাদানই শেষ হয়ে গেছে। আছে কেবল মরুৎ আর ব্যোম, অঢেল আছে।

শেষমেষ যা আছে তাই দিয়ে তাকে তৈরি করলেন ব্রহ্মা। তার না আছে শিং, না আছে নখ; দাঁত যা ছিল তাতে চিবোনো যায়, কামড়ানো চলে না; এই প্রাণী ডিম পাড়ে না তবুও তার ডিমের গুজব বাজারে শোনা যায়। তার ভেতরে ব্রহ্মা মরুৎ আর ব্যোম এত বেশি ঠেসে দিলেন যে, প্রাণীর মনটা হলো মুক্তিপাগল, কেবলই দৌড়ায়। এমনকি নিজের কাছ থেকেও পালিয়ে বেড়ায়। কামড়ায় না, ছিনিয়ে নেয় না, কাউকে মারধর করে না, কেবল ছুটে  বেড়ায়। দেহ উপাদানে ক্ষিতি, অপ, তেজের চেয়ে মরুৎ, ব্যোম বেশি হয়ে গেলে এমনই ঘটে বলে পণ্ডিতরা জানান ব্রহ্মাকে। তিনি থাকার জন্য কাউকে দেন অরণ্য, কাউকে দেন পর্বতমালা, কাউকে দেন  গুহা। কিন্তু নতুন এই প্রাণীকে দিলেন কেবলই খোলা মাঠ।

কিন্তু খোলা মাঠের চার পাশের বাসিন্দারা এই প্রাণীটিকে বশে এনে নিজেদের কাজে লাগাতে মুখে দিল লাগাম, পিঠে ছিল জিন, গলায় ফাঁসের টান, ঘাড়ে চাবুক। মাঠের চারপাশে দেয়াল উঠল। খোলা মাঠ থেকে প্রাণীটিকে দড়িতে টেনে আস্তাবলে ঢোকানো হলো।

প্রিয় প্রাণীর বন্দিদশা দেখে কষ্ট পেলেন ব্রহ্মা। হুমকি দিলেন- যদি একে মুক্তি দেওয়া না হয় তাহলে তার দেহে বাঘের মতো নখদন্ত জুড়ে দেবেন।

মানুষ প্রাণীটির সামনের দুপায়ে কষে দড়ি বেধে একে মুক্তি দিলো। ব্রহ্মা দূর স্বর্গ থেকে হাঁটুর নিচের শক্ত বাধন দেখতে পেলেন না। কেবল দেখলেন ওতো আর হাঁটতেই পারে না, দৌড়াবে কী করে? ব্যাঙের চলাও এর চেয়ে সুন্দর। ব্যাকুল ব্রহ্মা অতঃপর একে পুনরায় আস্তাবলে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন। এখন আস্তাবলবাসী এই প্রাণীটির নামই ঘোড়া কিংবা অশ্ব।

জীবনানন্দের 'ঘোড়া'

এই ঘোড়া'র একাংশ উদ্ধৃত করে কেবল আস্তাবলের ঘ্রাণ শুঁকে কাজ নেই, পুরোটাই পাঠ করা দরকার।

'আমরা যাইনি ম'রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:

মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,

প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে

পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে।

আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়;

বিষণ্ণ খড়ের শব্দ ঝ'রে পড়ে ইস্পাতের কলে;

চায়ের পেয়ালা কটা বেড়ালছানার মতে— ঘুমে—ঘেয়ো

কুকুরের অস্পষ্ট কবলে

হিম হ'য়ে ন'ড়ে গেল ও-পাশের পাইস্-রেস্তরাঁতে;

প্যারাফিন-লণ্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে

সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;

এই সব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।'

আবার অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে লিখেছেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী; আল মাহমুদের হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে 'বখতিয়ারের ঘোড়া'। নজরুল সৃষ্টি করেছেন 'কারবালার দুলদুল'। লিখেছেন-

'হায় হায় হোসেন উঠে রোল ঝনঝায়,

তলওয়ার কেপে উঠে এজিদেরো পাঞ্জায়

উন্মাদ 'দুলদুল' ছুটে ফেরে মদিনায়,

আলি-জাদা হোসেনের দেখা দেখা যদি পায়।'

দুলদুল। ছবি: সংগৃহীত

শামসুর রাহমানের 'দুলদুল'

শামসুর রাহমানের ঘোড়ার দেখা পাওয়া যায় তার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'স্মৃতির শহর'-এ। তিনি শৈশবে পোগোজ স্কুলে যেতেন সংক্ষিপ্ত পথ এড়িয়ে বাবু বাজারের দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে। কেন এর ব্যাখা তিনি হাজির করেছেন এভাবে- 'কারণ বাবুর বাজারে কয়েকটি ছবির দোকান ছিল। সে সব দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছবি দেখা যেত। তেমনি একটি দোকানে দেখেছিলাম দুলদুলের ছবি। কাচের আড়ালে তীরবিদ্ধ রঙিন দুলদুল। বিষাদ সিন্ধু পড়া ছিল বলে ইমাম হোসেনের ঘোড়া দুলদুল ছিল আমার চেনা।'

শিল্পের 'শ'টুকুও নেই এমন একটি ঘোড়ার ছবি শামসুর রাহমানকে এতোটাই দুগ্ধ করেছিল যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দেখেই তিনি তৃপ্ত হননি। টিফিনের পয়সা জমিয়ে দুলদুলের ছবি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

আবার আল মাহমুদের 'বখতিয়ারের ঘোড়া' নামের কবিতায় ঘোড়ার খুরের শব্দ আর বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয় একাকার হয়ে যায়।

পৃথিবীতে ঘোড়ার আবির্ভাব ঘটছে সাড়ে ৪ কোটি থেকে সাড়ে ৫ কোটি বছরেরও আগে। আর মানুষ ঘোড়াকে পোষ মানতে শিখেছে প্রায় ৬ হাজার বছর।

পৌরাণিক ঘোড়া পেগাসাস। ছবি: সংগৃহীত

গ্রিক ও অন্যান্য পুরানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে বিচিত্র চরিত্রের বহুসংখ্যক ঘোড়া। নিচে এমন কিছু ঘোড়ার উদাহরণ হাজির করা হলো:

অরিয়ন: দ্রুতগামী এবং কথা বলতে সক্ষম এমন ঘোড়া।

ব্যালিয়াস: অমর ঘোড়া; ঘোড়ার ঈশ্বর পসিডন উপহার হিসেবে ব্যালিয়াসকে দিয়েছিলেন।

সেনটাওর: অর্ধেক মানুষ অর্ধেক ঘোড়া।

জ্যানথুস: অ্যাকিলিসের ঘোড়া

হিপ্পোক্যাম্পাস: সমুদ্র ঘোড়া, যা পসিডনের চ্যারিয়ট টেনে নিয়েছে।

পেপাসাস: ডানাওয়ালা ঘোড়া।

অ্যাব্রাক্সাস: সূর্যদেব হেলিওসের ৪ ঘোড়ার একটি।

কোনাবোস: অগ্নিনিঃশ্বাস ফেলা এরিসের ঘোড়া।

স্কাইলা: পসিকনের চ্যারিয়ট-টানা ঘোড়া।

স্টেরোপ: অমর ঘোড়া।

শলিমা: কোরীয় পুরানের ডানাওয়ালা ঘোড়া।

স্লিপনির: নর্স পুরানের আটপেয়ে ঘোড়া।

কেলপিস: আকার বদলে ফেলতে পারা স্কটিশ পুরানের ঘোড়া।

গ্রিক দেব-দেবী ও ঈশ্বর-ঈশ্বরীদের নামেও একালে ঘোড়ার নামকরণ করা হয়। যেমন- এথিনা, হেরা জুনো, মিনার্ভা টেথিস। 

আবার পুরুষ ঘোড়ার নামকরণ হয়েছে অ্যাটলাস, হেরাক্লেস, হারকিউলিস, জুপিটার, মার্স, নেপচুন, পসিডন, ইউরেনাস ও জিউসের নামেও।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus's 'Reset Button' call was not about erasing Bangladesh's proud history: CA office

He meant resetting the software, not the hardware created by 1971 Liberation War, statement says

1h ago