মেনোপজ বোঝা কেন জরুরি?

স্টার গ্রাফিক্স

প্রথমবারের মতো ঋতুস্রাব বা মাসিকের অসহনীয় যন্ত্রণা ও কষ্ট ভোগের পর আমার কাছে মনে হয়েছিল, যাদের জীবনে কখনো ঋতুস্রাবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি, তারা সবচেয়ে ভাগ্যবতী। কোনো রক্তপাত, কোনো খিঁচুনি, কিংবা মুড সুইংয়ের মতো অবস্থা ছাড়া তারা কতটা শান্তিপূর্ণভাবে জীবন উপভোগের সুযোগ পেয়েছেন।

মেনোপজ সম্পর্কে জানার পর আমার কাছে আগের ধারণাটি ভয়ানক ভুল বলে পরিণত হয়। আমার মাকে এর মধ্যে দিয়ে যেতে দেখার আগে পর্যন্ত এই অসহনীয় অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমার তিল পরিমাণ ধারণা ছিল না।

মেনোপজ হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যখন কোনো নারীর ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক উপায়ে তার প্রজননের সুযোগ শেষ হয়ে যায়। সাধারণত, আমাদের দেশে মেনোপজ নিয়ে আলোচনা হয় না, বরং এটা নিয়ে কথা বলাকেও দেখা হয় ভিন্ন চোখে। আর তা এমন স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক একটা বিষয় মোকাবিলা করাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে মেনোপজের অনেক উপসর্গ এবং চিহ্ন থাকতে পারে, যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এই বিষয়টাকে কোনো সমস্যা হিসেবে দেখে না, এমনকি মেনোপজ-স্তরে থাকা একজন নারীর প্রতি তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সহানুভূতির দেখা মেলে না।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনেক চল্লিশ-পঞ্চাশোর্ধ নারীদের তীব্রভাবে ঘামতে দেখতাম, যেন তারা কোনো হট ফ্ল্যাশ অনুভব করছে। আমার মায়ের কাছ থেকে এই হট ফ্ল্যাশ সম্পর্কে আমি স্পষ্ট ধারণা পেয়েছিলাম। যখন সে মেনোপজের পর্যায়ে পৌঁছে, তখন সে হট ফ্ল্যাশের সম্মুখীন হয়েছিল, এমনকি ঘুমের মধ্যেও সে এই হট ফ্ল্যাশ অনুভব করেছে।

আমার মা ছিলেন একজন কর্মজীবী নারী, তাই এমন অবস্থায় তাকে কর্মস্থলে যেতে দেখা কিংবা রান্না করতে দেখাটা ছিল আমার জন্যে খুবই কষ্টকর বিষয়। আমাদের রান্নাঘরে পর্যাপ্ত কার্যকরী ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের দেশের অধিকাংশ রান্নাঘরেই থাকে না। যার ফলে, মেনোপজকালে একজন মা বা একজন গৃহকর্মীর জন্য সেখানে রান্না বা কোনো কাজ করা হয়ে যায় অত্যন্ত ক্লান্তিকর। এই সমস্যাগুলো উপলব্ধি করা বা বুঝতে না পারার পেছনে মূল কারণ অজ্ঞতা। মেনোপজ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাবে পরিবারের সদস্যদের কাছেই এই মর্মান্তিক বিষয়টা উপেক্ষিত হয়ে থাকে।

মেনোপজের আরেকটি সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে, মেজাজ পরিবর্তন, যাকে আমরা মুড সুইং বলে থাকি। যে কারণে আমাদের মায়েরা প্রতিনিয়ত তিরস্কার ও সমালোচনার শিকার হয়ে থাকে। অথচ, এই মানসিক পরিবর্তনের জন্যে সম্পূর্ণরূপে দায়ী হরমোনের ওঠানামা ও পতন। এসব হরমোন নারীর প্রজননস্বাস্থ্যচক্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা মানসিক অবস্থাকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। এই হরমোনের পরিবর্তন কখনো কখনো তীব্রও হতে পারে।

অথচ, এসব বিষয় না বুঝেই আমরা আমাদের মায়েদের বদমেজাজি, পাগলসহ অনেক কিছু বলে তিরস্কার করি। এমনকি, যখন এই অবস্থায় নারী তাদের মতামত দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন তা না শুনে কিছু মানুষ, বিশেষ করে পুরুষরা একে আকস্মিক কোনো বিস্ফোরণ মনে করে। আর এটা আমাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ করে। পুরুষরা যখন বুঝতে পারে যে তারা পরাজিত হচ্ছে, ঠিক তখনই তারা এমন বিভ্রান্তিকর কৌশল অবলম্বন করে।

বেশকিছু নারীর মেনোপজকালীন অভিজ্ঞতাগুলো জানার পরে একটা বিষয় আমাকে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত করেছে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারী যখন জীবনের এই পর্যায়টা অতিবাহিত করে, তখন তারা কারও সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে খুবই অনিরাপদ বোধ করে। মেনোপজকে বৃদ্ধ হওয়ার লক্ষণ ভেবে তাদের স্বামীদের সঙ্গে পর্যন্ত বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে ভয় পায়। অনেকে আবার নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাদের মাসিক নিয়ে মিথ্যাও বলে থাকে। তাদের ভয় হচ্ছে, মেনোপজের বিষয়টা স্বামীরা জানতে পারলে যদি তাদের নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দেয়, কিংবা তাদের আর ভালো না বাসে।

সমাজের এই সেক্সিস্ট মেন্টালিটি নারীদের জীবনের খুব স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়াকে কীভাবে একটা সামাজিক ট্যাবুতে পরিণত করছে, তা আমাকে খুবই বিস্মিত করেছে। জীবনের এই পরিবর্তনকালীন পর্যায়ে সব নারীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোটা আমাদের কর্তব্য।

অনুবাদ করেছেন এস এম সোহাগ

Comments

The Daily Star  | English
HSBC Bangladesh's Financial Highlights

HSBC to wind down retail banking in Bangladesh

HSBC will start winding down its retail banking operations in Bangladesh in the second half of this year, with the gradual process expected to take six to eight months.

10h ago