দ্বিতীয় ঠিকানা, নীলচে-সবুজ ঘাসের শহর লেক্সিংটন

দ্বিতীয় ঠিকানা, নীলচে-সবুজ ঘাসের শহর লেক্সিংটন
ছবি: নাদিয়া রহমান

বাড়ি ছেড়ে থাকার এক বছর হলো চলতি অগাস্ট মাসের ১০ তারিখে। তাই শুরুতেই নিজেকে অভিবাদন জানিয়ে নিচ্ছি! ঢাকা শহরের এককেন্দ্রিক পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। এই পরিবার ছাড়া আমার কোথাও থাকা হয়নি। তাও আবার ঢাকা শহরের একটি মাত্র এলাকা— ধানমণ্ডি থেকে শের-ই-বাংলা রোড। 

এ ছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসাব করলে আজিমপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়— এটুকুই ছিল দৌরাত্ম্য। এরপর কাজের ফেরে অফিস হলো মিরপুরের সেনানিবাসে। সেই জায়গাটুকুই নিজের ঘর থেকে মনে হতো আরেক শহর! 

ঘর বলতে, ছোটবেলা, আমার কৈশোরকাল থেকে তারুণ্যের যে টগবগে সময়গুলো সবগুলোই জড়িয়ে আছে এই সীমানার মধ্যে। ধানমন্ডি থেকে আজিমপুর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শুধু আমার নিজেরই নয়। বাবা যখন সে সময়ে আধুনিকায়নের শুরুতে মফস্বল ছেড়ে শহরে পড়তে আসেন, অন্যান্য তরুণের মতো স্বপ্ন নিয়ে, তখন থেকেই আমাদের ঠিকানা এই ধানমন্ডি এলাকাটি। 

এতদিনের চেনা অলিগলি, দোকানপাট ছাড়া আর যে শহরকে আপাত দৃষ্টিতে 'ঠিকানা' বলা যায় তা হলো— কেন্টাকির লেক্সিংটন। 

এই শহর আমার অন্ন সংস্থান করছে। এই শহরের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকি থেকে যেটুকু স্টাইপেন্ড দেওয়া হয়, তা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি উন্নত এবং পুঁজিবাদী দেশে ব্যয়বহুল পড়ার খরচ আসে আমার। শিক্ষার্থী হিসেবে পড়বার পাশাপাশি এই ক্যাম্পাসেই ক্লাস নিতে হয়, যা থেকে নিজের নিত্যদিনের খরচার পাশাপাশি বিভিন্ন শখ পূরণের সুযোগও হয়েছে। হিসেবের খেরোখাতায় যুক্তরাষ্ট্রে পড়বার কোনো পরিকল্পনাই আমার ছিল না। উচ্চশিক্ষা নিয়ে সেই ছোটবেলা থেকেই প্রবল ইচ্ছা থাকলেও সেটা আর যে মহাদেশই হোক, অন্তত মার্কিন মুল্লুক নিয়ে ছিল না। তারপরও জগতের বহু হিসাব-নিকাশে আমার ভাগ্য এখানেই নির্ধারিত হয়েছে।

লেক্সিংটন শহরসহ পুরো কেন্টাকিই পরিচিত ব্লু গ্রাসের স্টেট হিসেবে। সেই কবে, কোন অতীত থেকে কেন্টাকির চুনাপাথর (লাইমস্টোন) সমৃদ্ধ মাটিতে এই নীলচে-সবুজ রঙের ঘাসের দৌরাত্ম্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এখানে গড়ে উঠেছে অনেক আস্তাবল, হর্স ফার্ম। ঘোড়দৌড় বা কেন্টাকি ডার্বিতে বিজয়ী অনেক প্রজাতির ঘোড়ার নাম পাওয়া যাবে এই হর্স ফার্মগুলোয়। একেবারে দিগন্ত রেখার কাছে সাদা রঙের ফেন্স বা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ফার্ম, নীলচে-সবুজ নরম ঘাসের সীমাহীন বিস্তৃত মাঠ। আর প্রায়ই বর্ষণঘেরা দিনগুলো কৈশোরে পড়া ভিন দেশের বইয়ের প্রচ্ছদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। 

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরের মতো কোলাহল, ব্যস্ততা, শহুরের যান্ত্রিকতা এই লোকালয়ে তুলনামূলক কম। সন্ধ্যা নামতেই হলদে নিয়ন আলোগুলো জ্বলে ওঠে প্রতিটি বাড়ি, রাস্তার সম্মুখে। কেন্টাকি শহরের পূর্ব দিকে এগোলে দেখা মিলবে অ্যাপালেচিয়ান মাউন্টেইন বা পাহাড়ি শহরগুলো। এমন একটি ছোট্ট শহরে বার কয়েক যেতে হয়েছে ইন্টার্নশিপের কাজে। 

ছোট লেকঘেরা পাহারের ওপর বাড়ি, শিক্ষার্থীদের আবাসগুলো মনে করিয়ে দেয় ছোট ছিমছাম কিছু লোকালয়ের কথা। হলদে ল্যাম্পের আলোয় পাহাড়ঘেরা সাময়িক আবাসস্থলে বই পড়বার সময় বেশ স্বস্তি মেলে। তখন মনে হতেই পারে; বড় দালানঘেরা, হই-হট্টগোল থেকে কিছুটা সময় তো পাওয়া গেল! শত-সহস্র আধুনিকায়নের ভিড়ে কিছু পুরোনো জিনিস বেশ ভারিক্কি চালেই টিকে আছে এখানে। যার মধ্যে অন্যতম একটি হলো এই হলদে আলো। এরা আসলে জানে এবং বোঝে; সব নতুনদের জোয়ারে কিছু পুরনো জিনিসও রেখে দিতে হয়। হয়তো শান্ত, কোলাহলমুক্ত এবং কিছুটা বইয়ের প্রচ্ছদের মতো বলেই এই শহরে পেরিয়ে গেছে এক বছর।
  
সব মিলিয়ে নিজেকে আবারও অভিবাদন এক বছর এই নতুন এক শহরে কখনো মুখ বুজে, ভালবেসে আবার কখনো বা মানিয়ে নিয়ে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য।

 

নাদিয়া রহমান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

4h ago