‘হিন্দি-চীনী ভাই ভাই’—পুরোনো স্লোগান ফিরছে কি?

'হিন্দি-চীনী ভাই ভাই'—স্লোগানটি বললেই মনে ভাসে সদ্য স্বাধীন ভারত তথা মধ্য ১৯৫০ এর দশক ও এর প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কথা। মনে আসে ১৯৫৪ সালে অক্টোবরে নেহরুর সেই সময়ের পিকিং বা বর্তমানের বেইজিং সফরের ঘটনাপ্রবাহ।
ইতিহাস বলছে—সেসময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুং সফররত নেহরুকে বলেছিলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দুই দেশকে (চীন ও ভারত) পরাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না।'
প্রায় ৭০ বছর পর একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে কি?
গত বুধবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স'র এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় সাত বছর পর প্রথমবারের মতো চীন সফরে যাচ্ছেন ভারতের মোদি।'
সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে এতে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক চাঙা হওয়ার সুযোগ এসেছে।
নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের বর্তমান সম্পর্কের ওপর দৃষ্টিপাত করার আগে বলে রাখা দরকার যে, ১৯৬২ সালে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে প্রতিবেশী চীনের কাছে হেরে যাওয়ার পর সেই 'হিন্দি-চীনী ভাই ভাই' স্লোগানটি 'হারিয়ে' যায় বললে অত্যুক্তি হবে না। কেননা, সেই যুদ্ধের পর হিমালয়ের দুই পাশের দুই প্রতিবেশী ভারত ও চীন পরস্পরকে শত্রু ভাবতে শুরু করে।
হালে শুল্কযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল হওয়ায় নয়াদিল্লি ও বেইজিং আবারও নিজেদের 'ভাই' ভাবতে শুরু করে কিনা তাই এখন দেখার বিষয়।
আগামী ৩১ আগস্ট সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সম্মেলনে চীনের তিয়ানজিন শহরে যাবেন নরেন্দ্র মোদি। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক রয়টার্সের কাছে কোনো মন্তব্য করেনি।
যা হোক, ঐতিহ্যগতভাবে 'মস্কোপন্থি' ভারত নব্বইয়ের দশকে 'মার্কিনপন্থি' হতে শুরু করে। সবশেষ, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প-জামানা ও ভারতে মোদি-যুগের শুরু হলে দুই দেশের সম্পর্কের নতুন উচ্চতা দেখেন বিশ্ববাসী। দুই দেশের এই দুই জাতীয়তাবাদী নেতা একে অপরকে 'সত্যিকারের বন্ধু' বা 'প্রকৃত বন্ধু' হিসেবে আখ্যা দেন। একে অপরকে অভিনন্দন জানান। ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে জনসম্মুখে একে অপরকে বেশ কয়েকবার আলিঙ্গণ করেন। দুই দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি ও বিশ্ব শান্তিতে 'হুমকি' দেশগুলোর বিরুদ্ধে এক সঙ্গে কাজের অঙ্গীকার করেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার চিরশত্রু রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার অজুহাতে চীন ও ভারতকে শাস্তি দিতে চায়। হাজারো নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়া থেকে কম দামে তেল কেনে এই দেশ দুটি। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে রাশিয়ার সহযোগিতায়।
'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু'
রাজনীতিতে 'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু' প্রবাদ বেশ প্রচলিত। মার্কিন শুল্ক-খড়গ জোরালোভাবে পড়েছে চীন ও ভারত উভয়েরই ঘাড়ে। আর সে কারণেই কি এখন বেইজিংয়ের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে আগ্রহী নয়াদিল্লি? ২০১৮ সালের পর এই প্রথম চীনে যাচ্ছেন মোদি। ২০২০ সালে আলোচিত সীমান্ত সংঘাতের পর চীন-ভারত সম্পর্ক তলানিতে নামতে থাকে।
গত ৭ মে শুরু হওয়া ভারত-পাকিস্তানের চার দিনের যুদ্ধে 'সব সময়ের বন্ধু' বেইজিংকে পাশে পায় ইসলামাবাদ। সেসময় ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ থামে বলে দাবি করেন ট্রাম্প। এতে ক্ষেপে যান মোদি। গত তিন মাসে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির মধ্যে দূরত্ব এতটাই বেড়েছে যে, দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য আলোচনার সময় দুই বন্ধুর ফোনালাপ হয়নি। এখন ভারতের ঘাড়ে মার্কিন শুল্কের বড় বোঝা। ভারতের পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউরো-এশিয়া অঞ্চলের ১০ দেশ—বেলারুশ, চীন, ভারত, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানকে নিয়ে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সুসংহত করতে একসঙ্গে কাজের লক্ষ্য নিয়ে।
পাকিস্তান ছাড়া এই সংস্থার অন্য সব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রাশিয়ার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ। পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা চীনের সঙ্গে বেশি। অর্থাৎ, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোয় রাশিয়া ও বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল। আবার চিরবন্ধু রাশিয়ার থেকে তেল-অস্ত্র কেনায় ভারতের ওপর নাখোশ ট্রাম্প প্রশাসন।
চলমান ডলার-ভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া 'ব্রিকস'-কেও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। পাঁচ দেশের এই জোটে আছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দেশগুলোর সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো না। এদের মধ্যে ব্রাজিল ও ভারতের পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক ধরা হয়েছে।
'এক ইঞ্চি জমি ছাড়লে…'
'এক ইঞ্চি জমি ছাড়লে, এক মাইল নিয়ে নেবে'! ভারত, ব্রাজিলের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকাকে নিশানা চিনের— গতকাল শুক্রবার এমন শিরোনাম দেয় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারত, ব্রাজিলের মতো ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর ওপর ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘটনা নিয়ে এমনই মন্তব্য করেছেন ভারতে চীনের রাষ্ট্রদূত জু ফেইহং।
এতে আরও বলা হয়, 'সরাসরি নাম না করলেও চিনা রাষ্ট্রদূতের নিশানায় রয়েছেন ট্রাম্প, তা নিয়ে সংশয় নেই অনেকেরই। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নাম না করে "গুন্ডা" বলে আক্রমণ করেছেন তিনি।'
পত্রিকাটির ভাষ্য, ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরই ব্রাজ়িল প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট জানিয়েছেন তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো আলোচনা করবেন না। প্রয়োজনে ভারত, চীনের মতো 'বন্ধু' দেশগুলো সঙ্গে কথা বলবেন। এমন পরিস্থিতিতে 'সাংহাই সম্মেলনে' যোগ দিতে চাচ্ছেন মোদি। ২০১৯ সালের পর চীন সফর করতে যাচ্ছেন তিনি।
রয়টার্স জানায়, গত অক্টোবরে রাশিয়ায় ব্রিকসের সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কথা বলার পর এশিয়ার এই দুই শীর্ষ অর্থনীতির দেশের মধ্যে দূরত্ব কমছে।
গত ১৯ জুলাই বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়—ভারত ও চীন সতর্কতার সঙ্গে সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, দেশ দুইটির মধ্যে সীমান্ত আছে তিন হাজার ৪৪০ কিলোমিটার। এর কয়েকটি অংশ এতটাই বিতর্কিত যে প্রতিবেশী দুই দেশকে শত্রুতে পরিণত করেছে।
১৯৭৫ সালের পর ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। মৃত্যু হয়েছিল ২০ ভারতীয় ও চার চীনা সেনার।
সেই সংঘাতের পর সরাসরি ফ্লাইট ও ভিসা বন্ধ করে দিয়েছিল ভারত। গত জানুয়ারি পর্যন্ত পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ ছিল। ওই মাস থেকে, ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের তিব্বতের পবিত্র কৈলাশ ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
গত বছর চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ছিল ১২৭ বিলিয়ন ডলারের। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, চীন এখন পুরো মনযোগ তাইওয়ানের ওপর দিতে চায়। তাই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মেটাতে আগ্রহী বেইজিং।
এসব সমীকরণ মিটলে ফের কি 'হিন্দি-চীনী ভাই-ভাই' স্লোগান উঠবে?—মোদি-জিনপিং বৈঠকের পর সেটাই হবে দেখার বিষয়।
Comments