উচ্চশিক্ষায় ‘সিঙ্গেল’ নারীদের জন্য...

মানুষের তো কত রকমের স্বপ্নই থাকে। কেউ বলেন একেকটি স্বপ্নের সীমা আকাশসম। আবার অনেকে এই সীমাকেও ছাড়িয়ে তুলনা করেন। শুনতে সারাদিন ‘মুখ ডুবিয়ে বই’ পড়ার মতো শোনালেও আমার স্বপ্ন ছিল পশ্চিমের মহাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।
নাদিয়া রহমান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

মানুষের তো কত রকমের স্বপ্নই থাকে। কেউ বলেন একেকটি স্বপ্নের সীমা আকাশসম। আবার অনেকে এই সীমাকেও ছাড়িয়ে তুলনা করেন। শুনতে সারাদিন 'মুখ ডুবিয়ে বই' পড়ার মতো শোনালেও আমার স্বপ্ন ছিল পশ্চিমের মহাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। ঢাকা বিদ্যালয়ে থাকাকালে সেই প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকেই, কৈশোর বয়সে যখন চারপাশের পরিবেশ খুব প্রতিকূল ঠেকে তখন এই ইচ্ছা আরও প্রবল হয়। 

বিভিন্ন লেখকদের পাতা কিংবা টেলিভিশনের পর্দা থেকে মনে হত, কত স্বাধীনতাই না আছে শীতপ্রধান সেসব দেশে। ভাগ্যের ফেরে আমার শিক্ষকতা পেশায় আসা এবং এই পেশায় বর্তমানে উচ্চশিক্ষা 'বাধ্যতামূলক'। যদিও স্বপ্নের সেই 'স্বনামধন্য' বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উচ্চশিক্ষার জন্য যাতায়াত না হলেও, যে ক্যাম্পাসে আছি সেখানে অন্তত নিজের মতো করে গুছিয়ে চলার চেষ্টা চলমান। 

আমি যখন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা শুরু করি, তখন এই তালিকায় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আসলে খুব বেশি ছিল না। পরিবার থেকেও শুরুতে নেতিবাচক মনোভাবই ছিল প্রবল। এখন যুগের পরিবর্তনে এই প্লট অনেকটাই বদলে গেছে, যা আসলেই উৎসাহ জোগায়। এরপর দেশের বাইরে নতুন একটি পরিবেশে, সংস্কৃতিতে যখন পৌঁছে যাওয়া হয়, তখন শুরু হয় নতুন আরেক ধাপ- খাপ খাওয়ানোর। এই যাত্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা একেকরকম। 

কখনো ক্লাসে দেখেছি সহপাঠী ৫ বছরের সন্তানকে পাশে বসিয়ে নোটবুকে লেকচার তুলছে। আবার কিছু 'সিঙ্গেল মাদার' সহপাঠীকে দেখেছি একাই ক্লাস, লেকচার থেকে গবেষণা, ঘরদোর কী নিপুণভাবে সামলে নিচ্ছে। তাও বিরক্তির লেশমাত্র নেই। কেউ কেউ সাত সকালেও ক্লাসে পড়াতে যাওয়ার সময় নিজেকে পরিপাটি করে নিচ্ছে। আর আমি মাইনাস ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তুষারপাতে জ্বর নিয়ে ভাবছি 'এই প্রতিকূল আবহাওয়ায় বাজার কবে করা যাবে'। যুক্তরাষ্ট্রে যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই তাদের জন্য ভীষণ ভাবনারই বটে। তাছাড়া এখানে ভারী তুষারপাতের সময় সবকিছু কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমন নতুন এক পরিবেশে মাথা গোঁজার ঠাই করে নেওয়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ততটা সহজ নয়।

বিদেশে একজন 'সিঙ্গেল' নারী শিক্ষার্থীর দায়িত্ব এবং কাজ বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যিক। ছোটকাল থেকেই এখানে যে যার মতো স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠে। ব্যক্তিস্বাধীনতা এখানে অনেক সংবেদনশীল। কিন্তু আমরা যারা ভিন্ন পরিবেশ এবং সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠি তাদের জন্য এই পরিবেশ প্রায়শই একাকীত্ব তৈরি করে। সেখানে একজন নারী তবুও 'সিঙ্গেল', সেই হিসেবে বেশ কিছু প্রতিকূলতা তাকে পোহাতেই হয়। 'কেন একা পড়তে এলাম?', 'কেন এখনো পরিবার গুছিয়ে নিচ্ছি না'- এমন প্রশ্নও শুনতে হয়েছে কদাচিৎ। 

ছবি: নাদিয়া রহমান

এরপরও মনকে বোঝাতে হয়, যেখানে যে কয়টা বছর থাকব, মনমতো গুছিয়ে নিতে পারলেই হয়। গুছিয়ে নিতে গেলে প্রয়োজন হয় কেনাকাটার। ইংরেজি বিভিন্ন সিরিজে দেখতাম, ডর্মে উঠার সময় বিছানার ফ্রেম থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসবাব একাই বয়ে নিতে হয়। আমাকেও বিশাল ব্যাগ, নতুন কেনা জিনিসপত্র এভাবে বহন করতে হয়েছে। বিশেষ করে ২৮ ঘণ্টার যাত্রা, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলান্টিয়ার ঠিক করে নতুন বাসা নেওয়া এবং তাকে পরিপাটি করা। প্রথমদিকে একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর জন্য কিছুটা ভারী লাগাই স্বাভাবিক। শুরুর দিকে এমনও সময় গেছে, যখন দুটি কথা বলার মানুষও পাওয়া যায়নি। 

অনেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় পড়তে আসেন, আসেন কাজের সংস্থানে। সেই নতুন যাত্রাটাও নেহায়েত কম ঝক্কির নয়। তবে সুখের বিষয় মনে হয় দেশেই তো আছি। সংস্কৃতি, যাতায়াত ব্যবস্থা কিংবা খাদ্যাভ্যাসে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে হয় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভাবতে হয় বিমানের টিকিট খরচ নিয়েও। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে পুরো ক্যাম্পাস যখন ফাঁকা হয়ে যায়, তখন বাড়ি ফেরার ইচ্ছা থাকলেও তাকে উপেক্ষা করে যেতে হয়। তখন মনে প্রশ্নের উদয় হয়, 'আমার নিজের দেশেই যদি গবেষণার এত সুযোগ থাকত।' 

ধর্মীয় উৎসবগুলোতে বাড়ির কথা মনে পড়ে বেশি। ক্লাস শেষ করে ইফতারের সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুদিন। ঈদের দিনের সকালেও করতে হয়েছে অফিস। তবে একদিক থেকে অফিস করাকেই যৌক্তিক মনে হয়েছে, কেননা ডর্মে যাদের পরিবার-পরিজন কেউ নেই, তাদের কাজে ডুবে থাকাই বরং ভালো। তবুও মনকে প্রবোধ দেওয়া গেছে এই বলে যে, আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে বিনা খরচে ভিডিও কলের সুযোগ তো অন্তত রয়েছে। 

এতকিছুর পরও ভালো লাগে, যখন দেখি আমার দেশের নানা প্রান্ত থেকে মেয়েরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে আসছে। অন্যান্য দেশ থেকেও নারী শিক্ষার্থীরা আসে, তাদের মধ্যে মেলবন্ধন হয়। নতুন দেশে এতকিছুর ভিড়ে নিজেকে আলাদাভাবে পরিচয় করানোটাও চাট্টিখানি কথা নয়। একটা পরিচয়পত্রের পিছে লুকানো যত চেষ্টা, ধৈর্য আর অনিশ্চয়তাকে উপেক্ষা করার সাহস আছে, তার জন্য প্রতিটি মানুষকেই অভিবাদন।  

নাদিয়া রহমান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।   
 

Comments