তথ্য না জেনে ভ্রমণে বের হওয়ার বিড়ম্বনা

অন্য সুযোগ থাকলে সুইজারল্যান্ডে রাতের শেষ ফ্লাইট বা শেষ ট্রেনে ভ্রমণ না করাই ভালো। অনেকেই ভুল করে নয় বরং এই সময়ের ফ্লাইট ও ট্রেনের টিকিটের দাম তুলনামূলক কম থাকায় ওই তা কেটে থাকেন অনেকে।
ভ্রমণে বিড়ম্বনা
জেনেভা বিমানবন্দর। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

অন্য সুযোগ থাকলে সুইজারল্যান্ডে রাতের শেষ ফ্লাইট বা শেষ ট্রেনে ভ্রমণ না করাই ভালো। অনেকেই ভুল করে নয় বরং এই সময়ের ফ্লাইট ও ট্রেনের টিকিটের দাম তুলনামূলক কম থাকায় ওই তা কেটে থাকেন অনেকে।

অনেকেই ভাবেন—একটু রাত হবে তাতে কী, হোটেল তো পাবই। যে টাকা টিকিটে সাশ্রয় হয়েছে তার অর্ধেক না হয় ট্যাক্সিতে যাওয়া যাবে। তা ছাড়া, উবারতো আরও সাশ্রয়ী।

তবে এই সব সাশ্রয়ী হিসাবনিকাশ এক সময় এলোমেলো হয়ে যায় তথ্য না জানার কারণে। তখন পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। যতটুকু অর্থ বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছিল এর অনেক বেশি অর্থ এবং শ্রম শেষে ব্যয় হয়ে যায়।

২টা উদাহরণ দেবো এখানে।

প্রথমত, ২ দিন আগের ঘটনা এটি। প্রিস্টিনা থেকে ফ্লাইট আসবো জুরিখে। ফ্লাইটটি প্রিস্টিনাতেই দেড় ঘণ্টা দেরি করছিল। জুরিখে ঘন কুয়াশার কারণে ল্যান্ডিং সমস্যা ছিল। ২ ঘণ্টা দেরির পর ফ্লাই করে জুরিখে আসলে বিমানটি কুয়াশার কারণে ল্যান্ডিংয়ে আরও কিছু সময় ব্যয় করে।

এরমধ্যে জুরিখ বিমানবন্দরের ক্লোজিং টাইমের পর জরুরি অবতরণের অপেক্ষমাণ সময়ও শেষ হয়ে যায়। জুরিখে বিমানটি আর ল্যান্ড করার অনুমোদন পায়নি। পাইলট চেষ্টা করে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে ল্যান্ডিংয়ের জন্য। একই কারণে বাসেল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সায় পাইনি পাইলট। অগত্যা তিনি চলে যান ইতালির মিলান বিমানবন্দরে।

ইতালির বিমানবন্দরে রাতভরই বিমান উঠা-নামা করতে পারে যা সুইজারল্যান্ডের বিমানবন্দরগুলোয় সম্ভব নয়।

বলা হচ্ছিল যাত্রীদের মিলান থেকে ওই রাতেই বাসে জুরিখে পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু, তা সম্ভব হয়নি। এক টুকরো স্যান্ডউইচ আর জুস খেয়ে যাত্রীদের রাত কাটাতে হয়েছে বিমানবন্দরে। পরেরদিন সকালে মিলান থেকে বিমানটি জুরিখে যায়। যাত্রীরা ঘরে পৌঁছান দুপুরের পর।

এতক্ষণে কারণটা নিশ্চয় বোঝা গেল। জুরিখ ও বাসেল বিমানবন্দরে ওই ফ্লাইট অবতরণের সুযোগ পেল না, সুযোগ পেল ইতালির বিমানবন্দরে। কারণ, মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডে কোনো বিমান উঠা-নামা করতে পারে না। সে সময় বিমানবন্দরের কার্যক্রম একদমই বন্ধ থাকে। কার্যক্রমের একাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক এ ভাবেই বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন ও স্টেশনগুলোও।

কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যর এক আমির গভীর রাতে নিজের উড়োজাহাজ নিয়ে এসেছিলেন জুরিখে অবতরণের জন্য। পরে অবশ্য বিশেষ পদ্ধতিতে তার উড়োজাহাজটি গভীর রাতে অবতরণ করানো হয়েছিল।

বলা হয়েছিল, জরুরি চিকিৎসার জন্য সেই ফ্লাইটটিকে বিশেষ অনুমোদনে অবতরণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সমালোচেকরা অবশ্য বলছিলেন ভিন্ন কথা। প্রভাবের কথা। ওই ঘটনার পর এখন পর্যন্ত গভীর রাতে নিয়ম ভেঙে ফ্লাইট অবতরণের ঘটনা জুরিখ বিমানবন্দরে ঘটেনি।

এবার দ্বিতীয় উদাহরণ টানছি অন্য এক গল্প দিয়ে। এটিও ১৫ দিনের বেশি পুরনো নয়।

বাংলাদেশ থেকে পর্তুগাল আসবেন বেশ কয়েকজন টেলিভিশন সাংবাদিক। লিসবনে নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রী বিষয়ে নিউজ কাভার করতে এসেছিলেন তারা। সেনজেন ভিসায় সীমিত সময়ে ইউরোপের অনেক দেশই সাধারণত পর্যটকেরা ঘুরে দেখতে চান। এর মধ্যে সুইজারল্যান্ড অন্যতম।

যতটুকু সম্ভব ততটুকু ঘুরবেন এটাই স্বাভাবিক। সবাই সুযোগ পেলে সুইজারল্যান্ডও একটু ঘুরে আসার চেষ্টা করেন।

সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ফোন আসলো সময় কম তাই একটা দিন ও রাত তারা শুধু জুরিখে কাটাতে চান। তাদের হাতে সময় নেই। যতটুকু ঘোরা যায় এই আর কী।

টাইম টেবিল জানিয়ে দিলেন অমুক দিন পর্তুগাল থেকে তারা জুরিখে আসবেন। অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষা শেষে তাদের সাড়া না পেয়ে জানতে পারলাম তারা তখন প্যারিস থেকে ট্রেনে জেনেভা আসছেন।জেনেভায় যখন তারা পৌঁছবেন তখন অন্য শহরে যাওয়ার আর কোনো গণপরিবহন চালু থাকছে না।

মানে তাদের পক্ষে জুরিখে আসা সম্ভব নয়। তারা গভীর রাতে জেনেভা পৌঁছলেন। একদিন পর আবার তারা জেনেভা থেকে ভেনিসে ফ্লাই করবেন। এভাবেই তারা দেশ থেকে টিকিট কেটে এসেছেন। সমস্যা হলো সঠিক নিয়মগুলো না জানা।

ওই রাতে স্থানীয় এক প্রবাসীর সহযোগীতা সত্ত্বেও তারা জেনেভায় কোনো হোটেলেই রুম নিতে পারেননি।

সারারাত তাদেরকে জেনেভা শহরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। যা হোক রাতের জেনেভা শেষ করে তারা সকালে আসেন সলোথুর্ন শহরের প্রবাসী এক বন্ধুর বাসায়। কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আশেপাশের শহর ঘুরে রাতেই ট্রেনে চলে যান জেনেভায়।

জেনেভা থেকে ভোর ৮টায় তাদের ফ্লাইট। আবারও তাদের সামনে সেই জেনেভার রাত এসে ভর করলো। এই রাতেও তারা যখন আসছেন তখন কোনো হোটেল তারা জোগাড় করতে পারেননি। রাত ১২টা পর্যন্ত জেনেভা শহর ও পরের রাতটুকু তাদের কাটাতে হয়েছে জেনেভা বিমানবন্দরে।

যদিও সবারই থাকবার কথা ছিল জুরিখে আমাদের মেহমান হয়ে। মেহমানদের খাওয়াদাওয়া ও ঘুমানোর রুম গুছিয়ে রেখেছিলেন গিন্নি। অথচ সঠিক প্লানিংয়ের অভাবে তাদেরকে পড়তে হয়েছে গভীর ভোগান্তিতে।

এখন প্রশ্ন—এমন ভোগান্তির পিছনে কারণ বা ভুলটা কোথায়?

যদিও এমন ভুল করা মানুষের সংখ্যা মোটেই কম নয়।

অনেকেই এমন ভুলের মধ্যে অজান্তেই পড়ে যান। তথ্য না জানার কারণেই এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় অনেককে।

এমন ভ্রমণ বিষয়ে আরও এক ভোগান্তির উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

এ ঘটনাটি গত গ্রীষ্মের শেষের দিকের। ভিসা থাকতেও যাদের বিমানবন্দরে আটকে থাকতে হয়েছে ২ দিন।

দেশের প্রথম শ্রেণির এক কর্মকর্তা সস্ত্রীক জুরিখে আসবেন। ২ মাস আগেই তিনি যোগাযোগ করেছেন। পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলায় খুবই দক্ষ এবং অভ্যস্ত তিনি। আমার পরামর্শ মতো তিনি জুরিখে হোটেল নিশ্চিত করেছিলেন এক মাস আগেই। ৩ দিন থাকবেন। দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরবেন। সেভাবেই পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল।

যথা সময়েই তারা আসলেন। প্রথমে পর্তুগালে। আসার পরও কথা হলো বেশ কয়েকবার। তিনি তার ফ্লাইটের আইটিনারিও পাঠালেন। দেখলাম তিনি জুরিখে আসবেন লন্ডন থেকে। কথা হলো আবারো। জানালেন তারা লিসবন থেকে লন্ডনে গেছেন এবং লন্ডন থেকে জুরিখের দিকের ফ্লাইটে উঠেছেন। উড়োজাহাজে উঠে তিনি আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছেন। আড়াই ঘণ্টা পর ল্যান্ডিং।

যথা সময়ে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম। ফ্লাইট চলে এসেছে যথা সময়ে। কিন্তু, তারা বের হলেন না। তাদের কোন খবরাদি পাইনি। ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষা করে চলে আসলাম বাসায়। জুরিখ বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে গেল। কোন খোঁজ নিতে পারলাম না।

ভোররাতে তিনি মেসেজ পাঠালেন তাদেরকে জুরিখ বিমানবন্দরেই আটকে রাখা হয়েছে। তাদের ভিসা হলো সেনজেন সিঙ্গেল এন্ট্রি। অর্থাৎ, সেনজেন দেশে প্রবেশের পর বের হয়ে গেলে আর ওই ভিসায় সেনজেনভুক্ত দেশে ঢুকতে পারবেন না।

প্রথম যখন তারা পর্তুগালে এসেছেন তখনই যদি সুইজারল্যান্ডসহ আশেপাশের সব দেশ ঘুরে যেতেন তাহলে সমস্যা হতো না। কিন্তু, তারা তথ্যর ঘাটতিতে সেনজেন থেকে বেড়িয়ে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন। সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসায় একবার বের হয়ে গেলে ভিসার মেয়াদ থাকলেও আর সেনজেনভুক্ত দেশে ঢোকা সম্ভব নয়।

নিয়মটা সাধারণত দেশের ট্রাভেল এজেন্সিগুলো জানে। তারপরও অনেকেই ভুল করেন। তখন ভুলের খেসারত গুণতে হয় যাত্রীদের।

এই ভদ্রলোকের টিকেটগুলো বাংলাদেশের কোনো না কোনো ট্রাভেল এজেন্সি ইস্যু করেছিল। তারাই ভ্রমণের আইটিনারি তৈরি করে পরামর্শ দিয়ে থাকেন যাত্রীদের। তাদের তথ্য ঘাটতির কারণেই প্রতি বছর বহু সংখ্যক বাংলাদেশি পর্যটক এমন বিপদ ও বিড়ম্বনার শিকার হয়ে থাকেন। হয়রানির শিকার হই আমরাও। প্রবাসে সময় মিলানো সহজ নয়। এখানে সবাই রুটিন মাফিক কাজ করেন। দেখা যায়, কাজের পর গভীর রাতেও তাদের পাশে থাকতে হয়, সময় দিতে হয়।

যারা সুইজারল্যান্ডে ঘুরতে আসেন অল্প সময়ে অনেক কিছু ঘুরে দেখতে চান। সময় ও অর্থ সাশ্রয় করতে চান। এমন দর্শনার্থীদের প্রতি পরামর্শ হলো: আপনারা সুইজারল্যান্ডে যেখানে যাবেন, যাদের কাছে যাবেন, আপনার সেই সব স্থানের নিয়মকানুন ও আবহাওয়া পরিস্থিতি জানতে স্থানীয় পরিচিতদের সঙ্গে আলাপ করে ভ্রমণের পরিকল্পনা তৈরি করুন। এতে ভ্রমণ সহজ, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হবে।

এক সময় চাইলে সুইজারল্যান্ডে ট্রেন স্টেশনেও রাত কাটানো সম্ভব ছিল। গ্রীষ্মের রাতে বহু পর্যটক রাত কাটিয়ে দিতেন স্টেশনে।

রাত একটা বাজে তো, ৪ ঘণ্টা পরই ভোর। স্টেশনের বেঞ্চেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। এখন আর তা সম্ভব নয়। মধ্য রাতের শেষ ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গেই স্টেশনের সব দরজা বন্ধ করে দেয় নিরাপত্তা বিভাগ। এক্ষেত্রে অবশ্য ফেলিক্স বাস সার্ভিস ভিন্ন কথা বলে। ফেলিক্স বাসের মধ্য রাতের টিকিটের মূল্য সাধারণ সময়ের জন্য প্রায় ৩ গুণ। কারণ এ সব বাসে বড় দূরত্বে ভ্রমণে বাসেই রাত কেটে যায়। ভোরে নামতে হয় স্টেশনে। রাত কাটানোর জন্য হোটেলের দরকার পড়ে না। বাসই হোটেল আর কী! তাই এই রুটগুলোর বাসের টিকিটের দাম থাকে প্রায় ৩ গুণ।

পরের রাতের হোটেলে চেক-ইনের বিষয়টিও জেনে রাখা ভালো। সকাল বেলা আপনি গিয়ে হোটেলে উঠলেন আর হোটেল কর্তৃপক্ষ আপনাকে রুম দিয়ে দিবে—এমন আশা একদমই করা যাবে না।

গত সপ্তাহে এক বন্ধু জুরিখে আসলেন স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে। বাস থেকে সকালে নেমেই তিনি চলে গেছেন হোটেলে। তার ধারণা ছিল হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হবেন ঘুরতে। কিন্তু, যা চেয়েছিলেন তা আর হয়নি। তাদেরকে হোটেলের চেক-ইন করতে হয়েছে দুপুর ২টার পর।

পুরো সময় তিনি শিশু কন্যাকে নিয়ে কাটালেন হোটেলের লবিতে। ২টার পর রুমে প্রবেশ। ফ্রেশ হতে আরও ২/১ ঘণ্টা। ইতোমধ্যে শিশু সন্তান গভীর ক্লান্তির পরে বিছানা পেয়ে ঘুমিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে শীতের দিন শেষে রাতের অন্ধকার চেপে বসে। একদিন শেষ হয়ে গেল এমনভাবেই।

শিশুদের নিয়ে যারা ভ্রমণ করবেন অথবা শারীরিক ভাবে কম ফিট অথবা যারা প্রবীণ বা অসুস্থ তারা অবশ্যই ভ্রমণের পরিকল্পনা তৈরির আগে কমবেশি ভেবে নিবেন এটাই আশা করা যায়। শ্রম আর অর্থ ব্যয় করলেও পর্যটনের সময়টি সেভাবে কাজে লাগানো না গেলে আফসোস বেড়ে যায়।

এই ২ দিন আগে প্রিস্টিনা থেকে শেষ ফ্লাইটে ভ্রমণে ছিলেন এক বাংলাদেশি পর্যটক। তাকে আগেই সতর্ক করেছিলাম শেষ ফ্লাইটটি না নেওয়ার জন্য। তিনি বললেন, 'ভাইরে, যে টাকা সাশ্রয় হবে তা দিয়ে ট্যাক্সি ও হোটেলের খাবারের খরচ মিটে যাবে। আমি শুধু বলেছি, 'আসেন, আল্লাহ ভরসা'।

তিনি জুরিখের হোটেলে পৌঁছতে পারেননি। পরশুদিন তার মিলান থাকার কথা। আল্লাহর ইচ্ছায় একদিন আগেই তিনি মিলানে পৌঁছে গেছেন। তিনি আর এক রাতের জন্য জুরিখে আসলেন না।

বলছিলেন, এক রাতের হোটেলের টাকাটা কি ফেরত পাব?

আমি বললাম, 'কেমনে? হোটেল বুকিংয়ে নিশ্চয় শর্ত আছে। কারণ হোটেলও তো সাশ্রয়ী দামেই করা, তাই না।'

Comments