ডেঙ্গুর কার্যকর টিকা উৎপাদনে কেন সময় লাগছে

ছবি: সংগৃহীত

ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত ভাইরাসজনিত একটি রোগ। ব্রেক বোন ফিভার, ব্রেক হার্ট ফিভার অথবা সেভেন ডে ফিভার—সব নামেই ডেঙ্গু জ্বর পরিচিত। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, অতঃপর শক সিনড্রোম ও হেমারেজিক অবস্থা, তারপর মৃত্যু।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুতে সংক্রমণের সংখ্যা গত ২ দশকে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। ডেঙ্গু ইতোমধ্যেই ১০০টি দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে এবং প্রতি বছর নতুন নতুন অঞ্চলে এই ভাইরাসের সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

গত মার্চে সুদানের রাজধানী খার্তুমে প্রথমবারের মতো রেকর্ড পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। একই সময়ে আর্জেন্টিনায়ও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে। এর পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুর অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল। দেশটিতে সম্প্রতি ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে এবং গত ২৭ জুন পর্যন্ত ২৮০ জনেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন। বাংলাদেশেও আশঙ্কাজনকহারে ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হচ্ছে, ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা এবং সর্বজনীনভাবে প্রতিরোধেরও কোনো পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি।

এই অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গু থেকে সচেতন থাকতে, মশার কামড় এড়াতে ফুল-কভারেজ পোশাক পরা, মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, জানালায় নেট পর্দা বসানো এবং কেউ আক্রান্ত হলে উপসর্গ নিরাময়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ঘরে বা মশারির নিচে দিনের পুরো সময় অবস্থান করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যে কারণে গবেষকরা কয়েক দশক ধরে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর টিকা তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

২০১৫ সালে মেক্সিকো প্রথম সানোফি পাস্তুরের ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া নামের ডেঙ্গু টিকা অনুমোদন করে। সানোফির তথ্য মতে, পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এমন ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়সী মানুষ এই টিকা গ্রহণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে এই টিকা দেওয়ার আগে অবশ্যই পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে টিকাগ্রহীতার আগে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল।

সানোফি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি তথ্য সংগ্রহকারী গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যার কখনো ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়নি তিনি এই টিকা নেওয়ার পর ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগটি গুরুতর হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এ ছাড়া, এই টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সন্তানসম্ভবা মায়েদের বিষয়টি সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বুকের দুধ পান করানো মায়েরা যদি এই টিকা গ্রহণ করেন, তাহলে তা বুকের দুধ পানকারী সন্তানের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, সে বিষয়েও পরিপূর্ণ গবেষণা উপস্থাপিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে আরও গবেষণার প্রয়োজন থেকেই যায়।

জাপানি ফার্মা কোম্পানি তাকেদা কিউডেঙ্গা (টিএকে-০০৩) নামের একটি ডেঙ্গু টিকা তৈরি করেছে, যা আশাব্যঞ্জক ফলাফল দিয়েছে। এটি যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডেও অনুমোদিত হয়েছে। ৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী মানুষকে যেকোনো সেরোটাইপের ডেঙ্গু থেকে এই টিকা সুরক্ষা দেবে বলে জানানো হয়েছে। যদিও টিকাটির তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে।

সবমিলিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত একটি মাত্র ডেঙ্গু টিকা ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া অনুমোদন পেয়েছে এবং আরও প্রায় ৫টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে।

এমন অবস্থায় ডেঙ্গুর টিকা তৈরি হলেও ৩টি কারণে এখনো এর কার্যকারিতা নিয়ে গবেষকদের ভেবে দেখতে হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে:

১. ডেঙ্গু ফ্লাভিভাইরিডি পরিবারের একটি ভাইরাস এবং এর ৪টি স্বতন্ত্র, কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ৪টি সেরোটাইপ রয়েছে, যা ডেঙ্গু সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। এই মুহূর্তে কার্যকরী কোনো টিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি, যা ডেঙ্গুর এই ৪টি সেরোটাইপ থেকে রোগীকে সুরক্ষা দিতে পারে।

২. যেহেতু ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল মানুষ, যেমন: অল্পবয়সী শিশু, বয়স্ক ও দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। তৈরিকৃত টিকাগুলো যেহেতু শিশু ও বয়স্কদের নেওয়ার ক্ষেত্রে ফলাফল এখনো আসেনি, সে হিসেবে বিজ্ঞানীদের আরও সময় প্রয়োজন।

৩. যেহেতু ডেঙ্গু একটি তীব্র ভাইরাল সংক্রমণ, তাই সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তের টিকাগুলো তখনই ব্যবহার করা যাবে, যখন নিশ্চিত হওয়া যাবে যে টিকাগ্রহীতা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগী অসুস্থতার তৃতীয় বা চতুর্থ দিন পর্যন্ত সাধারণ জ্বর ভেবে বাসায় চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। প্রাথমিক পুরো সময়টা বাসায় পার করে অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে আসেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। এর ফলে ডেঙ্গু প্রতিরোধের ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকার মানুষের জন্য একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই অবস্থা বিবেচনায় গবেষকরা খুব দ্রুত ডেঙ্গুর কার্যকর টিকা উৎপাদন করতে সফল হবেন বলে আশা করছি।

ডা. কামরুজ্জামান নাবিল, ইস্পাহান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইরান।

ই-মেইল: [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Pathways to the downfall of a regime

The erosion in the credibility of the Sheikh Hasina regime did not begin in July 2024.

9h ago