ফিরে দেখা জুলাই গণঅভ্যুত্থান

২৯ জুলাই: রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান, ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আবার রাজপথে

গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের ধরতে পুলিশের অ্যাকশন। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

আগের দিন ২৮ জুলাই সমন্বয়কদের ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে বাধ্য করার ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছিল মানুষ। ২৯ জুলাই সোমবার রাজপথেও এর প্রতিফলন দেখা যায়।

এদিন রাজধানীসহ দেশের বেশ কিছু জায়গায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বাধা ও হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় কিছু শিক্ষার্থীকে আটকও করা হয়।

চট্টগ্রামে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। কুমিল্লায় আন্দোলনে যোগ দিতে যাওয়ার সময় এক শিক্ষার্থী পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে কয়েকজন শিক্ষকও যোগ দেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। বিক্ষোভ হয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও।

এ দিনেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে ঐকমত্য হয় ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে। সেখানে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

এর পাশাপাশি সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে মঙ্গলবার সারা দেশে শোক পালন করার সিদ্ধান্ত আসে মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে। কিন্তু সরকার ঘোষিত এই রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর বদলে একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।

গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, 'শিক্ষার্থীদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় শোককে প্রত্যাখান করে আগামীকাল লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তুলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি করার জন্য অনুরোধ করছি।'

সেই সঙ্গে তাদের পূর্বঘোষিত নয় দফা মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবারও আহ্বান জানান মাহিন।

জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না: হাইকোর্ট

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের 'কথিত আটক' ছয়জন সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট উল্লিখিত মন্তব্য করেন ২৯ জুলাই।

শুনানির একপর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, 'গতকাল টিভিতে দেখেছি, এই ছয়জন (সমন্বয়ক) কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে।'

একপর্যায়ে আদালত বলেন, 'এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেন করলেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না। যাকে নেন ধরে, একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন।'

এদিন সকালে আইনূন নাহার সিদ্দিকা এবং মানজুর আল মাতিন এই রিট আবেদনটি করেন।

আগের দিন ওই সমন্বয়কদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়ার কয়েকটি ছবি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়।

ওই পোস্টের ক্যাপশনে লেখা ছিল, 'কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই ডিবি কার্যালয়ে এনে তাদের সঙ্গে কথা বললাম।'

তথ্য অনুসন্ধানে আইনজীবী-শিক্ষকদের গণতদন্ত কমিশন গঠন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে রংপুরে আবু সাঈদের বুকে গুলি ছোড়ার ঘটনায় পুলিশের সাধারণ মানুষকে দোষারোপ করা এবং নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে দাবি করে এসব ঘটনার সঠিক কারণ উদ্ঘাটন, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে আইনজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা মিলে একটি 'জাতীয় গণতদন্ত কমিশন' গঠন করেন।

কমিশনের আট সদস্যের মধ্যে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতিআরা নাসরিন, আইনজীবী ও শিক্ষক শাহদীন মালিক, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ছিলেন।

জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত পহেলা জুলাই এ পর্যন্ত সংগঠিত বিভিন্ন সহিংস নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, গুলিবর্ষণ, হুমকি, মামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় তথ্য কমিশনের কাছে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হবে বলে জানানো হয়।

পল্টনে পুলিশের বাধায় শিক্ষার্থীদের মিছিল পণ্ড

ঢাকার পল্টন মোড় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনকারীরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দিয়ে সেটি পণ্ড করে দেয়। এসময় কয়েকজনকে আটকও করা হয়।

এদিন প্রেসক্লাব থেকে পল্টন মোড়—পুরো সড়কজুড়ে কড়া পাহারায় ছিল পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী। এ অংশে যান চলাচল ও দোকানপাট ছিল বন্ধ।

এছাড়া আদালত এলাকাতেও ছিল ব্যারিকেড আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যারিকেড।

২৯ জুলাই সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের ব্যানারে অনুষ্ঠিত সমাবেশ। ছবি: স্টার

শিক্ষার্থী হত্যায় দায়ীদের বিচারের দাবি শিক্ষকদের

২৯ জুলাই সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের ব্যানারে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশ থেকে সারাদেশে শিক্ষার্থী হত্যার পেছনে দায়ী ও জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নয় দফা মেনে নিয়ে অবিলম্বে দেশের সব ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার কথা বলেন তারা।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, 'হত্যা ও সহিংসতা বন্ধ, কারফিউ তুলে নেয়া, গুম- অপহরণ বন্ধ, জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত, আন্দোলনকারীদের অবিলম্বে মুক্তি ও শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন আমরা চাই।'

এই অধ্যাপক এটাও বলেন যে—'আমরা কাদের কাছে দাবি জানাবো, আমরা যাদের কাছে দাবি জানাব তারাই তো এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত।'

৩০ ঘণ্টা পর সমন্বয়ক আরিফ সোহেলের খোঁজ, রিমান্ড

২৭ জুলাই মধ্যরাতে পোশাকধারী আট-নয়জনের একটি দল আরিফ সোহেলকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে জানিয়েছিল পরিবার। এরপর ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সোহেলের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।

পরে ২৯ জুলাই সেতু ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আরিফ সোহেলকে ছয় দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। একই মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবকেও।

এদিন বিকেলে তাদের ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত প্রত্যেকের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।  

১৪ দলের সভায় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত

এদিন ১৪ দলীয় বৈঠকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, 'জাতীয় স্বার্থে দেশবিরোধী অপশক্তিকে নির্মূল করা প্রয়োজন। ১৪ দলের এই সভায় সর্বসম্মতি ক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, জামাত-শিবির গোষ্ঠী অপশক্তি রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য। জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।'

কাদের জানান, ১৪ দল মনে করে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও তাদের শিক্ষা জীবনের সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারকে পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

এক প্রশ্নের জবাবে ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, 'সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি, এখন সরকার এটা বাস্তবায়ন করবেন।'

 

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

5h ago