ফিরে দেখা জুলাই গণঅভ্যুত্থান

২৬ জুলাই: ব্লক রেইডের আতঙ্ক, তিন সমন্বয়ককে তুলে নেওয়া হলো হাসপাতাল থেকে

২০২৪ সালের ২৬ জুলাই ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণের চিত্র। সেদিন ছবির এই ব্যক্তির মতো অভিযানে আটক অনেককে আদালতে তোলা হয়। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সময়টা তখন মৃত্যুময়; সহিংসতায় বিপর্যস্ত। সে অবস্থাতেই ২৬ জুলাই ভোররাত থেকে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা নতুন করে আরেক ভীতিকর দৃশ্যের মুখোমুখি হলেন।

দেখা গেল, কখনো দিনের আলোয়, কখনো রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে এসব এলাকায়। বাহিনীর সদস্যরা মুহূর্তেই ঘিরে ফেলছেন পুরো এলাকা, অবস্থান নিচ্ছেন বিভিন্ন পয়েন্টে।

অভিযান শুরুর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টার্গেট করা বাড়ির ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সড়কবাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় অতিরিক্ত বাহিনী।

তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে শিক্ষার্থীসহ অন্য বাসিন্দাদের মোবাইল ফোন চেক করে দেখেন, দুর্ব্যাবহার করেন। মারধরের ঘটনাও ঘটে। আন্দোলনের সঙ্গে ন্যুনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা পেলে কিংবা মোবাইলে এ ঘটনার কোনো ছবি বা ভিডিও পেলেই তাকে তুলে নেওয়া হয়।

আবার অভিযুক্ত কাউকে না পাওয়া গেলে তার পরিবারের সদস্যদের তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এমনকি অভিযান চলার সময় ঘটনাস্থলে হেলিকপ্টার থেকে সার্চলাইটের আলো ফেলার মতো আতঙ্কের অভিজ্ঞতার কথাও জানান কেউ কেউ।

কার্যত ২৬ জুলাই থেকে ঢাকায় নতুন করে চালানো এই ব্লক রেইডের পাশাপাশি দেশজুড়ে চলতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। ওইদিন শুক্রবার পর্যন্ত সংঘাত-সহিংসতায় অন্তত ৫৫৫টি মামলা করে পুলিশ। গ্রেপ্তার ছয় হাজার ছাড়িয়ে যায়।

এদিন চট্টগ্রাম থেকেও ৩০ শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের খবর আসে।

চারদিকে আতঙ্ক

ব্লক রেইডের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় তখন। আতঙ্কিত পরিবারগুলোর অনেকেই ঢাকা ছেড়ে যান।

সে সময় এই ব্লক রেইড নিয়ে মুদ্রিত মাধ্যম ও ডিজিটাল—দুই প্ল্যাটফর্মেই বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে দ্য ডেইলি স্টার।

তখন যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকার এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ প্রতিটি রুম তল্লাশি করেছে। তার আগে আমাদের রুমের ও বাড়ির ছবি তুলেছে। তাদের অভিযান সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে গেছে।'

ওই শিক্ষার্থী জানান, তিনি যে ছয়তলা বাড়িতে থাকতেন, তার পুরোটিতেই পুলিশ তল্লাশি চালায় এবং গভীর রাতে চলে যাওয়ার আগে কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাঙচুর করে।

এ সময় তাদের অনেক প্রতিবেশী ঘরের বাতি নিভিয়ে দেন বলেও জানান ওই শিক্ষার্থী; যাতে পুলিশ মনে করে যে ওইসব ফ্ল্যাটে কেউ নেই।

ওই রাতে পুলিশের হাতে মার খাওয়া বাড়ির মালিকও জানান, তিনি বারান্দা থেকে দেখেন যে কয়েকজন পুলিশ কয়েক মিনিট ধরে দুজনকে মারধর করেছে। তাদের ওঠ-বস করতে বাধ্য করেছে এবং তাদের বলতে বাধ্য করেছে যে তারা আর কখনো কোথাও কোনো ধরনের প্রতিবাদ করবে না।

আবার হেলিকপ্টার

যাত্রাবাড়ীর অনেক পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই অভিযানের প্রায় একই রকম বর্ণনা দেন দ্য ডেইলি স্টারের কাছে।

মাতুয়াইলের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, অভিযানের সময় স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মীরাও পুলিশের সঙ্গে ছিল। আন্দোলনকারীরা কোন কোন বাড়িতে থাকে বা আন্দোলনকারীদের জন্য কোন কোন বাড়ি থেকে খাবার ও পানি দেওয়া হয়েছে সেটা দেখিয়ে দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা।'

ওই সময় মিরপুর ১২ ডিওএইচএসের বিভিন্ন বাসায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অভিযান চালায়। কারণ ডিওএইচএসের কাছাকাছি এলাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বসবাস করেন।

২৬ জুলাই ভোররাতে রাজধানীর শাহীনবাগ এলাকায় যৌথ অভিযান চালানো হয়। এ সময় স্থানীয়রা হেলিকপ্টারগুলো নিচু দিয়ে ওড়ার পাশাপাশি ও সার্চলাইট ব্যবহার করতে দেখার কথা জানান ।

একই কথা জানান, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দারাও।

তাদের ভাষ্য অনুসারে, অভিযান শুরুর আগে ২৫ জুলাই দিনের বেলায় পুলিশের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়—যেন কেউ বিকেল ৫টার পর বাইরে না থাকে। সন্ধ্যা গড়াতেই সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়তে থাকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই রাতের একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি ভবনের ওপর থেকে কেউ একজন তার মোবাইলে এই অভিযান রেকর্ড করার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছেন।

ওই রাতে মহাখালীতে ব্লক রেইড চালানো হয় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। ভয়ে অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র আশ্রয় নেয়।

হাসপাতাল থেকে তুলে নেওয়া হলো নাহিদ-আসিফ-বাকেরকে

২৬ জুলাই শুক্রবারনাহিদ ইসলামসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অন্য দুই সমন্বয়ক ছিলেন আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার।

একদল ব্যক্তি সাদাপোশাকে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ধানমন্ডির ওই হাসপাতাল থেকে তাদের তুলে নিয়ে যান। সে সময় ওই ব্যক্তিরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেন।

পরে রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, 'নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে নিয়েছি।'

এই তিনজনকে এর আগেও একবার তুলে নেওয়া হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা দাবি আদায়ে সারা দেশে 'কমপ্লিট শাটডাউন' বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি দেওয়ার পর ১৯ জুলাই মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়। ২১ জুলাই ভোরে পূর্বাচল এলাকায় তাকে ফেলে যাওয়া হয়। নাহিদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছিল আঘাতের চিহ্ন। এর পর থেকে তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

অপর দুই সমন্বয়ক আসিফ ও বাকেরকেও ১৯ জুলাই তুলে নেওয়া হয়েছিল। পাঁচ দিন পর ২৪ জুলাই আসিফকে হাতিরঝিল ও বাকেরকে ধানমন্ডি এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। এর পর থেকে আসিফও গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে তার সঙ্গে থাকছিলেন বাকের।

নিরীহ মানুষ হত্যার দায় বিএনপি-জামায়াতের: কাদের

২৬ জুলাই শুক্রবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় নিরীহ মানুষ হত্যার দায় বিএনপি-জামায়াতের। পুলিশ ও সাধারণ মানুষ কোনো হত্যায় অংশ নিতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির পেক্ষাপটে ছয় দিন নীরব থাকার পর সেদিন সংবাদ সম্মেলনে আসেন ওবায়দুল কাদের। বলেন, 'অনেক নিরীহ মানুষ মারা গেছেন। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যপট দেখতে ছিল...বাচ্চা যখন তাকাল, সেই বাচ্চা গুলি খেয়ে মারা গেল। তারপরে এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক ঘটেছে। রাস্তায় বেরিয়েছে, নিষ্পাপ, নির্বোধ শিশু, কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সে–ও লাশ হয়ে পড়ে ছিল। এ রকম ঘটনা অনেক আছে। এগুলো জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।'

ওই দিনেই আরেক অনুষ্ঠানে ইন্টারনেট বন্ধের প্রসঙ্গে যে কথা বলেন তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক, পরবর্তীতে তা জুলাই আন্দোলনের জনপ্রিয় একটি মিম-এ পরিণত হয়। পলক সেদিন বলেছিলেন—'সরকার দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে।'  

 

Comments

The Daily Star  | English

Patent waiver till Nov 2026: Local pharmas may miss window for 15 costly drugs

Bangladesh’s pharmaceutical companies risk losing the chance to produce at least 15 costly biologic drugs royalty-free

8h ago