২২ জুলাই: টিকে থাকতে চূড়ান্ত বলপ্রয়োগের পরেও হাসিনা বললেন, ‘ক্ষমতা কিছু না’

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে দেশজুড়ে টানা সহিংসতায় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য আহত মানুষ তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ২২ জুলাই তাদের মধ্যে অন্তত আরও ছয়জন মারা যান—চারজন ঢামেক হাসপাতালে এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। তাদের সবাই গুলি বা ছররা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বলে হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্র জানায়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২১ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ১৬৪টি মামলা করা হয় এবং ২২ জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী 'চিরুনি অভিযান' শুরু করে। এদিন সারাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীসহ এক হাজার ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
আগের দুদিনের মতো ২২ জুলাইও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। বলবৎ থাকে কারফিউ। তবে, দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়।
২২ জুলাই কোটা সংস্কার সংক্রান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপে সই করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে দুপুরে হাসিনা বৈঠক করেন কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
এ বৈঠকে বাংলাদেশ বিএবির অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, 'সরকারের পাশে আমরা ছিলাম, আছি ও থাকব।' তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, 'ব্যবসায়ীদের অসুবিধা বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।' বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ব্যবসায়ীদের আস্থা ও বিশ্বাস আছে। সরকার অনেক বেশি চেষ্টা করছে শিগগির সবকিছু স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে।' অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ চলছে উল্লেখ করে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর সেখানে দাবি জানান, যেন কারখানাগুলো অন্তত চালু করে দেওয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশে মঞ্জুর বলেন, 'অন্তত ই–মেইল যোগাযোগটা চালু করুন।'
উল্লেখ্য, ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় সরকার। এর ফলে পুরো দেশ কার্যত ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ব্যবসায়ীরাও তাদের বায়ারদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছিলেন না।
একদিকে যখন হাসিনার নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের—ছাত্রলীগ, যুবলীগ—নেতাকর্মীরা গুলি করে, পিটিয়ে ছাত্র-জনতা হত্যা করে চলেছে, অন্যদিকে তখন গণভবনে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই বৈঠকে হাসিনা বলেন, 'আমি ক্ষমতার জন্য কাজ করছি না, আমার কাছে ক্ষমতা কিছু না। আমি ক্ষমতার মুখাপেক্ষী না।' তিনি আরও বলেন, 'জামায়াত-শিবির পেছনে থেকে সারা দেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। বিএনপি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এবার কাউকে সহজে ছাড় দেওয়া হবে না।' তিনি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও সহিংসতার জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে দায়ী করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে 'আরও শক্ত অ্যাকশন' নেওয়ার কথা জানান।
তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, 'মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের কঠোর হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।' তিনি এই সহিংসতার জন্য বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করেন।
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'বিএনপি সচেতনভাবেই কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয়নি। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছে এটাকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার।'
২২ জুলাই সেনাপ্রধান যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েন করা সেনা সদস্যদের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। এ সময় সেনাপ্রধান বলেন, 'জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে।'
যাত্রাবাড়ী এলাকা পরিদর্শন করেন তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, র্যাবের মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ ও ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। এ সময় আইজিপি সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রতিটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য পাই পাই করে হিসাব দিতে হবে।'
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, 'পরিস্থিতির আরও উন্নতির জন্য কারফিউ অব্যাহত থাকবে। মঙ্গলবার দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আস্তে ধীরে কারফিউ শিথিলের সময় পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে।'
এ দিন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি স্থগিত করেন। রাজধানীতে আন্দোলনকারীদের তেমন তৎপরতা না থাকলেও পথে পথে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের ব্যাপক অবস্থান দেখা যায়। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান মোতায়েন ছিল। আকাশে ছিল পুলিশ-র্যাবের হেলিকপ্টার টহল।
Comments