জুলাই ৩১: ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে চড়াও পুলিশ, হাসিনা বললেন—‘আমার অপরাধটা কী’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে চব্বিশের ৩১ জুলাই সারা দেশে 'মার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এর অংশ হিসেবে সেদিন বুধবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন জায়গায় লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।
ঢাকায় সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদযাত্রা ঘিরে ধস্তাধস্তি হয়।
এই দিনেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনা প্রসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি জানি না, আমার অপরাধটা কী ছিল।'
সেদিন ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত 'জাতীয় মৎস সপ্তাহ-২০২৪' এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যান হাসিনা। আন্দোলন ঘিরে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এতে করে কে কী অর্জন করলো, সেটাই এখন প্রশ্ন।'
এর পাশাপাশি আন্দোলন চলাকালীন দেশব্যাপী ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনার 'চক্রান্তে' কারা জড়িত, সেটার বিচারের ভার তিনি 'দেশবাসীর' ওপর ছেড়ে দেন। সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতাও চান তিনি।

শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যোগ দিলেন শিক্ষকরা
এদিন মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির অংশ হিসেবে দুপুর ১২টা থেকে হাইকোর্টের মাজার গেট এলাকায় জড়ো হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। পরে প্রায় তিন ঘণ্টা শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমানসহ কয়েকজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হাইকোর্টের ভেতরে আইনজীবীদের একটি দলও মিছিল করেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ বেলা একটার দিকে মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের দিকে যেতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকেরাও অংশ নেন। বেলা একটার দিকে কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনসংলগ্ন মহুয়া মঞ্চের সামনে জড়ো হন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে তারা সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের ১০-১৫ জন শিক্ষক যোগ দেন।
রাজশাহীতে কর্মসূচি পালন করতে শিক্ষার্থীরা আদালতের সামনে সমাবেশ করবেন খবর পেয়ে সকাল থেকেই ওই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সেখানে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যদেরও অবস্থান করতে দেখা যায়।
এ কারণে শিক্ষার্থীরা সেখানে কর্মসূচি পালন করতে না পারলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল ও প্রতিবাদী সমাবেশ করেন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের ৯ দফা মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বরিশালের কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিপেটা
বরিশালে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এতে চার সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। এ সময় কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক করে পুলিশ।
৩১ জুলাই বেলা ১১টার পর নগরের সদর রোডসংলগ্ন কাঠপট্টি সড়কের মুখে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রতিবাদ মিছিল করার চেষ্টা করলে পুলিশ প্রথমে বাধা দেয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েকজন অভিভাবককেও এ কর্মসূচিতে একাত্ম হতে দেখা যায়। একপর্যায়ে বাধার মুখে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। পরে সিটি কলেজের গলির মুখে শিক্ষার্থীদের আটকে দেওয়া হয়। আরও শিক্ষার্থী এক জোট হয়ে সদর রোডে অবস্থান নিলে ধাওয়া দিয়ে তাদের ফকিরবাড়ি রোডে আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে।
সিলেট, গাজীপুরেও পুলিশের বাধা
সিলেটে দুপুরে সুবিদবাজার এলাকায় কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থীরা বাধা পেরিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এতে শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ফয়সাল হোসেন।
এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাজীপুর শহরের রাজবাড়ী রোডের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে সড়কের দুই পাশে ব্যারিকেড দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাধা সৃষ্টি করে।
পরে শিক্ষার্থীরা দুপুর ১টার দিকে জেলা শহরের লেভেলক্রসিং এলাকা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় আশপাশের এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিলে যোগ দেন। পরে মিছিলটি শিববাড়ি হয়ে শিমুলতলীর ডুয়েটের দিকে যেতে থাকে। মিছিলটি ওই সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে: অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান
এদিন সারা দেশে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) শিক্ষকরা।
বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এই সমাবেশ থেকে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, 'এই হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহযোগীদের দ্বারা হয়েছে। যাদের আমরা বলতে পারি প্রাইভেট বাহিনী। এর বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের জন্য অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক তদন্ত দরকার।'
সলিমুল্লাহ খান এ সময় সরকারকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে পদত্যাগের দাবিও জানান। বলেন, 'কেউ কি বিশ্বাস করেন এ সরকারের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারা এর (হত্যাকাণ্ডের) ন্যায়বিচার করতে পারে? তারা হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে না। কারণ, তারা নিজেরাই হত্যাকারী। যারা নিজেরাই রাজাকার, তারা অপরকে বলে রাজাকার। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী আছে। মানে যারা খুনি, যারা বিশ্বাসঘাতক, তারা আমাদের বলে খুনি, বিশ্বাসঘাতক।'
ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক খুলে দিলো সরকার
৩১ জুলাই ঢাকায় বিটিআরসি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর জারি করা সরকারি বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার কথা জানান।
পলক বলেন, 'বাংলাদেশের সাইবার স্পেসে ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের কার্যক্রম পরিচালনা করতে আমরা আর কোন বাধা রাখছি না। সবগুলো অ্যাপ্লিকেশন আমরা ওপেন করে দিচ্ছি। আশা করি বিকালের মধ্যে সবগুলো অ্যাপ্লিকেশন ওপেন করে দিতে পারব। আমরা দেখেছি, এসব বিধিনিষেধ আরোপের ফলে ভিপিএন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের কারণে আমাদের ব্যান্ডউইথ ট্রাফিক দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেটা নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকি, অপরদিকে আর্থিকভাবেও ক্ষতি।'
ডিবি থেকে সরানো হলো হারুন অর রশীদকে
এদিন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদকে ডিবি থেকে সরিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগে সরিয়ে নেওয়ার আদেশ জারি হয়।
নতুন করে ডিবি বা গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব পান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আশরাফুজ্জামান।
হারুন অর রশীদ নানা ঘটনায় বেশ আলোচিত ছিলেন। বিশেষ করে আন্দোলন চলাকালীন ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে ছয় সমন্বয়কদের সঙ্গে খাওয়ার খাওয়া ছবি ও ভিডিও প্রকাশের পর উচ্চ আদালত এটিকে 'মশকরা' বলে ভর্ৎসনা করেন।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে ওবায়দুল কাদের
৩১ জুলাই সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময়ের জন্য ডেকে কথা বলতে না দেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় সাবেক ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ 'ভুয়া ভুয়া' বলেও স্লোগান দেন।
এদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। বেলা ১১টায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাবেক ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকেও আগের দিন জানানো হয়। অন্যদিকে ছাত্রনেতারা জানান, তাদেরকেও মতবিনিময় সভার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ছাত্রলীগের কয়েক শ সাবেক নেতা দলীয় কার্যালয়ের দোতলার সম্মেলনকক্ষে উপস্থিত হন। এর মধ্যে সংসদ সদস্য, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতারা ছিলেন। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা বা মতবিনিময় না করেই গণমাধ্যমের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে শুরু করেন ওবায়দুল কাদের।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রথমে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। পরে তা হট্টগোলে রূপ নেয়।
'রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস' কর্মসূচির ঘোষণা বৈষম্য বিরোধীদের
'মার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচির পরদিন বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা আসে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের পক্ষ থেকে। এই দিনের কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় 'রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস'।
৩১ জুলাই সন্ধ্যায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে নয় দফা দাবি আদায়ের জন্য নতুন কর্মসূচির অংশ হিসেবে 'নির্যাতনের ভয়ংকর দিন-রাতগুলোর স্মৃতিচারণ', 'শহীদ ও আহতদের নিয়ে পরিবার ও সহপাঠীদের স্মৃতিচারণ', 'চিত্রাঙ্কন/গ্রাফিতি, দেওয়াল লিখন, ফেস্টুন তৈরি, ডিজিটাল পোট্রেট তৈরি' এবং 'ক্যাম্পাস ও এলাকা ভিত্তিক প্রতিবাদ ও সাংস্কৃতিক আয়োজন' এর মতো কর্মসূচি পালনের কথা বলা হয়।
নতুন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে আহ্বান জানানো হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
Comments