ফিরে দেখা জুলাই গণঅভ্যুত্থান

৩৬ জুলাই: পালাল হাসিনা, ছিঁড়ল স্বৈরাচারের শিকল

গণভবনে সাধারণ মানুষ। ছবি: এএফপি

ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনগণের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে শেষ কামড় দিতে দিতেই ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। একদিকে তিনি যখন হেলিকপ্টারে করে দেশ থেকে পালিয়ে ভারত যাচ্ছিলেন, অন্যদিকে তখনও তার অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা হত্যা করে চলেছে শত শত মানুষকে।

ছাত্র-জনতার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ও তীব্র প্রতিরোধের মুখে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশ মুক্ত হয় স্বৈরাচারের শিকল থেকে।

আগের দিন হঠাৎ পূর্বঘোষিত ৬ আগস্টের 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সেটাই হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীদের জন্য 'ট্রাম্প কার্ড'। অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে দীর্ঘসময় ধরে মানুষ মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া হাসিনার অনুগত আইনশৃঙ্খলা ও ক্যাডার বাহিনী।

৫ আগস্ট কড়া কারফিউ উপেক্ষা করেই 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি সফল করতে লাখো মানুষ রাজধানী অভিমুখে পদযাত্রা করেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। ভোর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও শহরতলী থেকে মানুষ রওনা হন শাহবাগ অভিমুখে। ঢাকার বাইরে থেকেও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে রাজধানীতে আসতে থাকে মানুষের স্রোত। রাজধানীর রাজপথ দখলে নেয় লাখ লাখ মানুষ।

কিন্তু, হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করে যান। ৫ আগস্ট সকাল থেকেই রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এতে অনেক মানুষ নিহত ও আহত হন।

একপর্যায়ে দুপুরের দিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ঘোষণা দেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান, সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে, শান্তি-শৃঙ্খলার পথে ফিরতে।

হাসিনার পদত্যাগের খবর নিশ্চিত হওয়ার পরই জনতার উল্লাসে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে হাসিনার ক্ষমতার আধিপত্য, আওয়ামী লীগের কথিত রাজনৈতিক দুর্গ।

গণভবনে সাধারণ মানুষ। ছবি: এএফপি

শাহবাগ থেকে আনন্দ মিছিল করতে করতে বিক্ষুব্ধ জনতা চলে যান হাসিনার বাসভবন গণভবনে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ, গণভবনে প্রবেশ করে মানুষ তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করে। বিজয় উদযাপন করে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আবালবৃদ্ধবনিতা রাজপথে দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পতন উদযাপন করে।

হাসিনা পালিয়ে গেলেন ৫ আগস্ট। অথচ, এর কিছুদিন আগেই ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই গর্ব করে তিনি বলেছিলেন, 'শেখ হাসিনা পালায় না।'

হাসিনা পালিয়ে গেলেও বিরত থাকে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিছু জায়গায় হাসিনার পলানোর তথ্য না পেয়ে এবং কিছু জায়গায় জনরোষ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তারা নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে।

সারা দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে থাকে। হামলা হয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, পদধারী বড় নেতা ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে মানুষে ক্ষতিকারীদের বাড়ি, দলীয় কার্যালয়ে। হামলা হয় থানাগুলোতেও। দেশের অধিকাংশ থানার কার্যক্রম বন্ধ করে পালিয়ে যান পুলিশ সদস্যরাও।

এ দিন, হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'সবার আগে দেশ, তারপর দল, এরপর ব্যক্তি। আমরা পরস্পর পরস্পরের পাশে থেকে সহযোগিতা করব।'

গণভবনের মানুষ। ছবি: রয়টার্স

বিকেল পৌনে ৪টার দিকে সেনাপ্রধান জানান, একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। দেশবাসীকে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সব হত্যার বিচার হবে।

জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।

৫ আগস্ট রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানান, অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এর বাইরে কোনো সরকার মেনে নেওয়া হবে না।

এ ছাড়া, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সুযোগে কোথাও যেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা লুটপাট না হয় সে বিষয়ে হুঁশিয়ারি দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।

হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। 'তিনি এতটাই হতাশ যে তার কঠোর পরিশ্রমের পরও কিছু লোক তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন।'

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই আন্দোলনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। দেশ পরিণত হয়েছিল রক্তাক্ত প্রান্তরে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনটিকে ক্ষমতাসীনরা গায়ের জোরে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে ১৬ জুলাই থেকে শুরু হয় নিরীহ ছাত্রদের রক্ত ঝরা। ছাত্রদের রক্ত দেখে দেশের মানুষ আর বসে থাকতে পারেনি। হাসিনার দীর্ঘ জুলুমের বিরুদ্ধে তারাও রুখে দাঁড়ান।

আন্দোলন যখন সহিংস হয়ে ওঠে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা সারাদেশে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে হাসিনাকে প্রকাশ্য ক্ষমা চাওয়াসহ বেশ কয়েকটি দাবি জানান। কিন্তু সরকার তা না করে আন্দোলন দমনে নানা কৌশল, এমনকি আরও বল প্রয়োগের পন্থা অবলম্বন করে। যার ফলে হাজারো মানুষকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে হাসিনার অনুগতরা।

শেষ পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে। এক দফা ঘোষণার পর দমনপীড়ন আরও বেড়ে যায়। ১৬ জুলাইয়ে শুরু হওয়া হাসিনার হত্যাকাণ্ড চলতে থাকায় শিক্ষার্থীরাও জুলাইকে প্রলম্বিত ধরে গণনা শুরু করে। তারা ঘোষণা দেয়, হাসিনার পতনের আগে জুলাই শেষ হবে না। যার ফলে ১ আগস্ট হয়ে ওঠে ৩২ জুলাই, ২ আগস্ট ৩৩ জুলাই এবং সর্বশেষ ৫ আগস্ট, অর্থাৎ ৩৬ জুলাই পালিয়ে যান হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে চলে যান ভারতে।

দেশের মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি, ১ জুলাই শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত 'জুলাই গণঅভ্যুত্থান'-এ রূপ নেবে। আর চূড়ান্ত বিজয় পাবে '৩৬ জুলাই'।

৫ আগস্ট বাংলাদেশের জন্য একদিকে যেমন নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার দিন, একাধারে এটি চূড়ান্ত পর্যায়ের মর্মান্তিক দিনও। এদিন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও পুলিশের বর্বর হামলায় অনেক মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজারো মানুষ। আজও শহীদদের পরিবারে ঝরে চলেছে বিষাদের অশ্রু, হাসপাতালে কাতরাচ্ছে অসংখ্য আহত ছাত্র-জনতা, অঙ্গহানি হয়ে অনিশ্চিত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন হাজারো মানুষ।

Comments

The Daily Star  | English

6 killed as microbus plunges into canal in Noakhali

The accident took place around 5:40am in Chandraganj Purba Bazar area

1h ago