শিক্ষা-স্বাস্থ্যে জোর দেওয়ার কথা বললেও বরাদ্দ বেড়েছে অল্পই

এ বছরের বাজেটে ভৌত অবকাঠামোর চেয়ে জনগণের জন্য বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে বলে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন।

কিন্তু বাজেট প্রস্তাবের পর দেখা গেছে উভয় খাতেই বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় বেড়েছে খুবই সামান্য।

কম বরাদ্দের কারণে হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলেছেন, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কৌশলগত পরিকল্পনারও অভাব রয়েছে।

অপরদিকে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতীত রেকর্ড দুর্বল বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বরাদ্দের চেয়ে বেশি জোর দিতে বলছেন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ওপর।

অর্থ উপদেষ্টা বাজেটে ওষুধের কাঁচামাল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ওপর কিছু কর সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। এতে কিছু ওষুধের দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সোমবার বাজেট বক্তৃতায় সালেহউদ্দিন বলেন, 'ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।'

বাজেটে শিক্ষা খাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

শিক্ষার জন্য বরাদ্দ মোট বাজেটের প্রায় ১২ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগের বাজেটের চেয়ে মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। শিক্ষায় বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৭২ শতাংশ।

অথচ ইউনেসকোর সুপারিশ হলো, জিডিপির অন্তত ৪-৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ করা।

বাজেট প্রস্তাবনায় দেখা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ আগের অর্থবছরের ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা করা হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন জানান, সরকার কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি ১৯ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। মাদ্রাসার এমপিওভুক্তির জন্য সরকার ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে।

এছাড়া, 'সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি'র জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।

গণস্বাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'আসলে এই অন্তর্বর্তী সরকার এমন একটা জটিল অবস্থায় পড়েছে, যেটাকে বলা যায়—চ্যালেঞ্জে ঠাসা। কোথাও স্থিতিশীলতা নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'একদিকে প্রচুর ঋণ, অন্যদিকে লুটপাট। আবার প্রতিযোগী খাতগুলোর মধ্যে চাপ আছে—আপনি এনার্জি দেবেন, না শিক্ষা আর স্বাস্থ্য খাতে দেবেন।'

'তবে এই সরকারের সদিচ্ছা আছে বলে মনে হচ্ছে। পলিটিক্যাল গুড উইল আছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নে রোডম্যাপ নাই। ওয়ে ফরোয়ার্ড নাই। তাহলে তারা এগোবে কীভাবে,' প্রশ্ন রাখেন তিনি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা সংস্কারের জন্য আমরা কোনো উদ্যোগ দেখিনি।'

প্রাথমিক স্তরের জন্য সরকারের একটি কমিটির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'গত চার মাসে আমাদের জমা দেওয়া কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।'

তিনি আরও বলেন, 'এ বছরের বাজেটে আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কিছু বাড়েনি। শিক্ষা খাত অনেক দিন ধরে স্থবির রয়েছে। এই বাজেটেও তা থেকে উত্তরণের কথা নেই।'

'কাজেই বলতেই হয় আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি হতাশ,' বলেন অধ্যাপক মনজুর।

তিনি আরও বলেন, 'রেটোরিক সবসময়ই কিছু থাকে, সেগুলোরই পুনরাবৃত্তি, কিন্তু কাজের কোনো উদ্যোগ, লক্ষণ দেখছি না। আর আগে থেকে তো কাজ করতে হয়। বাজেটে তার প্রতিফলনটা থাকে। এখানে যেটা হয়েছে, কাজও নেই, বাজেটও নেই।

স্বাস্থ্য খাত

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বা ০ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।

এ দুই মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পাচ্ছে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা অন্যান্য খাতের মধ্যে সপ্তম এবং এটা স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের চেয়ে অনেক কম।

গত মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন। কমিশন স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বা জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করেছিল।

তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।  এ কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে বরাদ্দের চেয়ে বাস্তবায়নের বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া বেশি প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ এপ্রিল পর্যন্ত সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দের মাত্র ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে, যা অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সর্বনিম্ন।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অবস্থা কিছুটা ভালো। এ বিভাগ ৫ হাজার ৬৭৩ কোটি ৫১ লাখ টাকার বাজেটের ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যয় করেছে, যা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শেষ থেকে পঞ্চম এবং বাজেট বাস্তবায়নে জাতীয় গড় ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশের অনেক কম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মন্ত্রণালয় যেন বরাদ্দকৃত বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারে, সেদিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারের উচিত তহবিল ব্যবহার করতে না পারার কারণ চিহ্নিত করা এবং বরাদ্দের ১০০ শতাংশ ব্যয় নিশ্চিত করার জন্য প্রথম দিন থেকেই সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো।'

তিনি আরও বলেন, 'সংশোধিত বাজেটের নামে মূল বরাদ্দ থেকে এক টাকাও কমানো উচিত নয়।'

'যদি মন্ত্রণালয় বর্তমান বরাদ্দ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে আগামী অর্থবছরে আরও ১-২ শতাংশ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত,' বলেন তিনি।

নতুন অর্থবছরে অর্থ উপদেষ্টা স্বাস্থ্য খাতে কিছু কর সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন, যাতে কিছু ওষুধের দাম কমতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

ওষুধ প্রস্তুতকারকদের ওপর চাপ কমাতে এবং ক্যান্সার, কিডনি এবং হৃদরোগের চিকিৎসা আরও সাশ্রয়ী করতে ৭৯টি ওষুধের কাঁচামাল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।

বাজেটে ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত ২৩ ধরনের নতুন কাঁচামাল, ডায়াবেটিসের মতো রোগের ওষুধের ৩৬ ধরনের কাঁচামাল এবং ২০ ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জামের আমদানি শুল্ক মওকুফের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে, প্রায় ২০০টি ওষুধ প্রস্তুতের কাঁচামাল আমদানিতে একই ধরনের ছাড় আছে।

দেশে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দিতে রেফারেল হাসপাতাল ছাড়াও, ৫০ এর বেশি শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর শুল্ক আরও কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।

বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, '২০৩০ সালের মধ্যে সকল নাগরিককে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে সেবার পরিধি বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষ জনবল নিয়োগে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।'

তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আগামী অর্থবছরে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য অতিরিক্ত ৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser yunus confirms election date

Election in February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night announced that the general election will be held before Ramadan in February 2026, kickstarting the process of handing over the power to an elected government.

4h ago