আরেকটি ঈদ এলো, পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি সাভারের চামড়া শিল্প নগরী

এ বছর পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতিরিক্তি সরবরাহ থাকলে পর্যায়ক্রমে চামড়া সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
কাঁচা চামড়া, চামড়া শিল্প, সাভার চামড়া শিল্প নগরী, ট্যানারি,
সাভার চামড়া শিল্প নগরীর ভিতরে একটি বর্জ্য শোধনাগারের দৃশ্য। স্টার ফাইল ফটো

প্রতিবছর কোরবানির ঈদে কাঁচা চামড়ার সরবরাহ বাড়ে। কিন্তু, সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর ধারণ ক্ষমতা প্রয়োজনের চেয়ে কম। এই সমস্যা সমাধানে গত দুই দশক ধরে ঈদে উৎপাদিত কাঁচা চামড়া শতভাগ প্রক্রিয়াজাত করার মতো একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এ বছর পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতিরিক্তি সরবরাহ থাকলে পর্যায়ক্রমে চামড়া সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

ঈদের পরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে সংগৃহীত কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করবে চামড়া ট্যানাররা। কারণ, রাজধানী ও এর আশেপাশের ব্যবসায়ীরা আগে চামড়া আনেন।

বর্তমানে, চামড়া শিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য শোধন করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু, কোরবানির ঈদে বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ঘনমিটারে। কারণ, ট্যানারি মালিকরা সারা বছর যে পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন, তার অর্ধেকই আসে ঈদুল আজহায়। এর আগের বছর প্রায় এক কোটি পশু কোরবানি হয়েছিল।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যের বরাতে বলেছিলেন, 'এ বছর প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত আছে।'

কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ফলে সৃষ্ট দূষণ থেকে মুক্তি পেতে দেশের চামড়া শিল্পকে সহায়তা করতে এই শিল্প নগর স্থাপন করা হয়। কিন্তু, ২০০৩ সালে চামড়া শিল্প নগর নির্মাণের কাজ শুরু হলেও এটি এখনো পুরোপুরি কার্যকরী তরল ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, লবণ বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা এবং সাধারণ ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার ইউনিট স্থাপনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।

ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়াস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানির (ডিটিআইইডাব্লিউটিপিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশতাক আহমেদ বলেন, 'চামড়া শিল্প নগর ও সিইটিপি নির্মাণের পরিকল্পনার প্রাথমিক পর্যায়ে কার্যকরী তরল ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, লবণ বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা এবং সাধারণ ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু, পরে তা বাদ দেওয়া হয়।'

এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

সাভার চামড়া শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার ইতোমধ্যে ১ হাজার ৮০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু, মুশতাক আহমেদ বলেন, 'এটি পুরোপুরি কার্যকর করতে আরও ১ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।'

নবারুণ ট্যানারির কর্মকর্তা কবির হোসেন বলেন, 'আমাদের কোম্পানি ১০ হাজার পিস কাঁচা চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। দাম কম হলে আমরা এই সংখ্যা দ্বিগুণ করব।'

বৈশ্বিক মান অনুযায়ী মূল্যবান কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণে বাংলাদেশ ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। চামড়া শিল্প বাংলাদেশের কয়েকটি খাতের মধ্যে একটি, যার কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়। এখান থেকে আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ আছে।

কিন্তু, বৈশ্বিক স্বীকৃতির অভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মূলত চীনে চামড়া রপ্তানি করতে হয়। এছাড়া, উন্নত বাজারে চামড়জাত পণ্য পাঠাতে রপ্তানিকারকদের অন্যান্য দেশের কারখানা থেকে কাঁচা চামড়া আমদানি করতে হয়।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে, যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই শিল্পে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের খাত হওয়ার সক্ষমতা আছে।

পুরোপুরি কার্যকর সিইটিপি না থাকার আরেকটি অসুবিধা হলো নিকটবর্তী ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে। অর্থাৎ, ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তরের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

২০১৭ সালে বুড়িগঙ্গাকে পুনরুজ্জীবিত করার আশায় ট্যানারিগুলো সাভারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, ট্যানারি স্থানান্তরিত হলেও তাদের প্রক্রিয়া এখনো নদীগুলো দূষিত করছে।

গত সোমবার সাভার চামড়া শিল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার মৎস্যজীবী মোহাম্মদ নাসিরের সঙ্গে কথা বলেন ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক।

নাসির বলেন, 'আমি ৩০ বছর ধরে ধলেশ্বরী নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছি। বর্ষাকালে মাছ ঠিক আছে বলে মনে হয়। কিন্তু, বছরের অন্যান্য সময় মাছের মধ্যে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যায়। গত বছরের বেশির ভাগ সময় আমি রিকশা চালিয়েছি এবং মাঝে মাঝে মাছ ধরেছি।'

ডিটিআইইডব্লিউটিপিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সিইটিপি বর্জ্য শোধন করতে ৫৩ ঘণ্ট সময় নেয়, তবে স্ট্যান্ডার্ড সময় ৭২ ঘণ্টা হওয়া উচিত। আর বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট প্রসেস ২৫ ঘণ্টা সময় নেয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টা হওয়া উচিত।

পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিইটিপির নকশা ত্রুটিপূর্ণ ছিল ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই স্থাপন করা হয়েছিল। এমনকি এটির কোনো পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই এবং এটি কিছু শর্তের ভিত্তিতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।'

Comments