জৌলুস হারাচ্ছে ২০০ বছরের পুরোনো বালিকান্দি চামড়ার বাজার

সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় চামড়ার বাজার মৌলভীবাজারের বালিকান্দি চামড়ার বাজার। ২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই বাজারের আগের জৌলুস আর নেই।
সিলেট, বালিকান্দি চামড়ার বাজার, মৌলভীবাজার, কোরবানির ঈদ, কোরবানি, কাঁচা চামড়া,
২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই বাজারের আগের জৌলুস আর নেই। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় চামড়ার বাজার মৌলভীবাজারের বালিকান্দি চামড়ার বাজার। ২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই বাজারের আগের জৌলুস আর নেই। ন্যায্য মূল্যে কোরবানির চামড়া বিক্রি করতে না পেরে হতাশ ব্যবসায়ীরা। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে দাম পেয়ে বিপাকে পড়েছেন।

এদিকে লবণের দাম বৃদ্ধি ও দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে হাজার হাজার কোরবানির পশুর চামড়া নষ্ট হয়ে যায় প্রতিবছর। ফলে, বালিকান্দি চামড়ার বাজারের সেই জৌলুস দিন দিন হারাতে বসেছে।

স্থানীয়রা জানান, চামড়া ব্যবসা ওই গ্রামের ২০০ বছরের ঐতিহ্য। অথচ অনেকে লোকসানে পড়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। একসময় চামড়া ব্যবসায়ীরা মৌলভীবাজারে এসে কোরবানির চামড়া তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রহ করতেন কিংবা অগ্রিম টাকা আনতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এখন আর আগের মতো ব্যবসায়ীদের দেখা যায় না। তাই স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সংগ্রহকারীরা চামড়া বিক্রি করতে না পেরে শহরে নিয়ে যান। এখন হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী আছেন। অথচ, একসময় এখানে বিরাট ব্যবসা ছিল।

জৌলুস হারাচ্ছে মৌলভীবাজারের ২০০ বছরের পুরোনো বালিকান্দি চামড়ার বাজার
ন্যায্য মূল্যে কোরবানির চামড়া বিক্রি করতে না পেরে হতাশ ব্যবসায়ীরা। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

বালিকান্দি গ্রামের চামড়া ব্যবসায়ী মজবিল মিয়া বলেন, 'গত বছর বিদ্যুতের অভাবে চামড়ার প্রাথমিক প্রক্রিয়ার কাজ করতে পারিনি। তাই আমি গত বছর ১ হাজার চামড়া নদীতে ফেলে দিয়েছিলাম। এ বছর অবশ্য পরিবেশ এখনো ভালো। যদিও লবণের দাম অনেক বেশি।'

চামড়া শ্রমিক আল-আমিন বলেন, 'প্রতি বছর কোরবানির ঈদে লবণের দাম বাড়ে। গত বছর লোডশেডিংয়ের সমস্যা ছিল। রাতে ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় চামড়া প্রসেস করতে পারিনি। আমি ৫০০ চামড়া নদীতে ফেল দিয়েছিলাম। এই বছর কী হয় সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না।'

মৌসুমি চামড়া বিক্রেতা সাবের মিয়া বলেন, 'এবার ছোট আকারের গরুর চামড়া ৫০-১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর মাঝারি ও বড় আকারের গরুর চামড়া ১৫০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে অধিকাংশ আড়তদার ছোট আকারের গরুর চামড়া এবং খাসি ও বকরির চামড়া কিনতে চান না। ছোট আকারের গরুর চামড়া কেউ আনলে ৫০ টাকা দামও বলছেন ব্যবসায়ীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরুর চামড়ার সঙ্গে ছাগলের চামড়া 'ফ্রি' পাওয়া যাচ্ছে।'

বালিকান্দি বাজারের চামড়া ব্যবসায়ী মাহমুদ মিয়া বলেন, 'আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী। এই ব্যবসা করে পথে বসেছি। প্রতি ৫০কেজি লবণে ৭-১৫টির মতো চামড়ায় লবণ দেওয়া হয়। আর ৫০ কেজি লবণ কিনতে প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকা লাগে। গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণের দাম বেড়েছে। গতবারের আগের বছর প্রায় ৩ হাজার চামড়া কিনেছিলাম। কিন্তু, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লবণের উচ্চমূল্যের কারণে অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। আর গত বছর অসুস্থ ছিলাম তাই ব্যবসা করতে পারিনি। এ বছর আবার এই ব্যবসায় এসেছি। কিছু চামড়া কিনছি। ‍দেখি কী হয়। তবে, এই বাজারে আগের ব্যবসা নেই।'

জৌলুস হারাচ্ছে মৌলভীবাজারের ২০০ বছরের পুরোনো বালিকান্দি চামড়ার বাজার
লবণের দাম বৃদ্ধি ও দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে হাজার হাজার কোরবানির পশুর চামড়া নষ্ট হয়ে যায় প্রতিবছর। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

বালিকান্দি চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শওকত আলী বলেন, 'এ বছর এখনো পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না। গত বছর বিদ্যুতের কারণে অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের বাপ-দাদার ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা ব্যবসা করি। কয়েক বছর আগে শত শত ব্যবসায়ী থাকলেও এখন মাত্র ৭-৮ জন আছে।'

'ঢাকা ও নাটোরের ট্যানারি মালিকরা আমাদের অনেক টাকা আটকে রেখেছেন। ট্যানারি মালিকরা প্রতি বছর সরকার নির্ধারিত মূল্যের সমান মূল্য দেয় না। আমরা চামড়া কিনে লবণ দিলেও তারা আমাদের অর্ধেক দাম দেয়। এটা আমাদের ক্ষতি। তাদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারি না,' বলেন শওকত আলী।

তিনি আরও বলেন, 'দাম কম থাকায় চামড়া সংগ্রহকারীরা আমাদের কাছে চামড়া বিক্রি করেন না। তারা কেউ মাটিতে পুঁতে রাখে, কেউ নদীতে ফেলে দেয়। এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে এ শিল্প রক্ষার আবেদন জানাই।'

মৌলভীবাজারে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মাইদুল ইসলাম বলেন, 'এভাবে নদীর পানিতে চামড়া ফেললে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, 'স্থানীয়ভাবে আলোচনা করে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি।'

Comments