বাংলাদেশের ঈদ-অর্থনীতি

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ব্যবসা হয় প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে পোশাক খাতে খরচ হয় ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। নামাজের টুপি থেকে শুরু করে দুধ, চিনি ও আনুষঙ্গিক প্রায় সবকিছুর পেছনেও অনেক টাকা খরচ হয়।
ঈদের আগে ঢাকার বিপণি বিতানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড়। ছবি: এমরান হোসেন

শুক্রবারের প্রথম প্রহর। প্রকৃতিতে তখনো রাতের অন্ধকার কাটিয়ে দিনের প্রথম আলো ফোটার আয়োজন চলছে। এমন শান্ত ভোরে নির্জন বাগবাড়ি গ্রামের এক টিনের বাড়ি থেকে যন্ত্রের একঘেয়ে শব্দ ভেসে আসছে বাতাসে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই রাজিয়া সুলতানার। তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে সেলাই মেশিনে কাজ করছিলেন।

ঈদুল ফিতরের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এখনো হাতে ৫০টি পোশাক সেলাইয়ের কাজ পড়ে আছে। তাই ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করছেন ৪৫ বছর বয়সী এই নারী।

এবারের ঈদে রাজিয়ার কাছে জামা তৈরির অর্ডার পাঁচগুণ বেড়েছে। এই বাড়তি আয়ের একটি অংশ ঈদে খরচ হবে। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার লক্ষ্য অন্তত ৫০ হাজার টাকা আয় করা। এর একটি অংশ সঞ্চয় করব। বাকিটা দিয়ে ঈদের খরচ মেটাব।'

রাজিয়ার কঠোর পরিশ্রম দেশব্যাপী শ্রমজীবী মানুষদের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। সবাই দেশের এই বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবের জন্য তাদের মেধা-শ্রম ঢেলে দেন।

পবিত্র রমজান শেষে আনন্দ, ঐক্য ও উদারতার প্রতীক হিসেবে উদযাপিত ঈদকে ঘিরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির (বিএসওএ) জরিপে দেখা গেছে, ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ব্যবসা হয় প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে পোশাক খাতে খরচ হয় ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। নামাজের টুপি থেকে শুরু করে দুধ, চিনি ও আনুষঙ্গিক প্রায় সবকিছুর পেছনেও অনেক টাকা খরচ হয়।

উৎসবের মর্মবাণীর সঙ্গে মিল রেখে উপহার-দান-খয়রাত দেখা যায় পুরোদমে। ঈদকে সামনে রেখে দাতব্য কাজে সহায়তা করা হয় যাতে দরিদ্ররাও উৎসবে অংশ নিতে পারেন।

দোকান মালিক সমিতির হিসাব অনুসারে, প্রায় ৪৯৫ কোটি টাকা ফিতরা হিসেবে দেওয়া হয়। প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জন্য এই দান বাধ্যতামূলক। এমনকি, আরও অনেক বেশি অর্থ অনানুষ্ঠানিকভাবে বিতরণ করা হয়। বিশেষ করে, যখন তিন দিনের ঈদে মানুষ গ্রামের বাড়িতে যান তখন অনেককে দরিদ্রদের দিকে সহায়তার হাত বাড়াতে হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে—ঈদ উপলক্ষে প্রায় চার-পাঁচ কোটি মানুষ যাতায়াত করেন। পরিবহন খাত সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেকে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের আর্থিক সহায়তা দেন। এর ফলে সম্পদের পুনর্বণ্টন হয়।'

সাধারণত ঈদকে সামনে রেখে রেমিট্যান্স আসা তুলনামূলক বাড়লেও গত মার্চে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। প্রবাসীরা গত মাসে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এটি অর্থনীতিকে চাঙা করতে ভূমিকা রাখবে।

এ ছাড়াও, ঈদকে সামনে রেখে বহু মানুষের অস্থায়ীভাবে কাজের সুযোগ তৈরি হয়।

মিরপুর-১ এর বাটা জুতার দোকানের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল কবির ডেইলি স্টারকে জানান, চলতি মাসের জন্য চুক্তিভিত্তিক অতিরিক্ত ২৮ বিক্রয় সহকারী নেওয়া হয়েছে।

ঈদে বিপুল পরিমাণে নগদ লেনদেন হয়ে থাকে। এটি অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান রাখে। প্রায় সব ব্যবসায় ভালো বিক্রি হয়। অনেকে ঘর সাজাতে এবং উপহার দিতে জামা-কাপড়, গহনা, আসবাবপত্র ও অন্যান্য পণ্য কেনেন।

উৎসবে মিষ্টি ও মজাদার খাবার থাকে। সে সময় অতিথিদের আপ্যায়নে ২৭ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা খরচ হয়।

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবাই ঈদকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করতে চান। সেদিন ভালো খাবার খেতে চান। নতুন কাপড় পড়তে চান। সে সময় অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও বেড়ে যায়।'

ফ্রিজ-টেলিভিশনের মতো পণ্যের বিক্রি বাড়াতে লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচারণা ও নানা আয়োজনের মাধ্যমে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করার প্রস্তুতি ব্যবসায়ীরা কয়েক মাস আগেই নিয়ে থাকেন। রমজান শুরুর পরপরই শপিং মল ও মার্কেটগুলোতে হাজারো মানুষের ভিড় হয়।

ফ্যাশন হাউস সারা লাইফস্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম খালেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, আমাদের মোট বিক্রির প্রায় ৪০ শতাংশই হয় ঈদের এই সময়টাতে।

ঈদকে সামনে রেখে নতুন ডিজাইন তৈরির পাশাপাশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে অনেক কাজ হয়ে থাকে। উৎসবের প্রায় এক বছর আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।

দোকান মালিক সমিতির জরিপে দেখা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে একটি পোশাক ব্র্যান্ডের দৈনিক বিক্রি গড়ে তিনগুণ বেড়ে যায়।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড অঞ্জনসের কর্ণধার শাহীন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদে ছেলেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোশাক পাঞ্জাবি তৈরি বেড়ে যায় ১০ শতাংশ।'

সারা লাইফস্টাইলের খালেদ জানান, গত বছরের তুলনায় ১৭ রমজানের পর তাদের বিক্রি বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

সুতাসহ কাঁচামালের দাম বেশি ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ বছর পোশাকের দাম বেড়েছে। পোশাকের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান 'রঙ বাংলাদেশ'র প্রধান নির্বাহী সৌমিক দাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাঞ্জাবির কাপড়ের দাম গজপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'গ্রাহকদের ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপানোর পরিবর্তে মুনাফা কমিয়েছি। ক্রেতারা ইতোমধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আর্থিক সংকটে আছেন।'

ঈদকে সামনে রেখে বেড়ে যায় জুতার চাহিদাও। বাটার হেড অব রিটেইল আরফানুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মোট বিক্রির প্রায় ২৫ শতাংশ হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে। এ সময় জুতা বিক্রি তিনগুণ বেড়ে যায়। অর্ধেক নতুন ডিজাইনও বাজারে আসে।'

ঈদের সঙ্গে রান্নার বিষয়টিও জড়িত। তাই চিনি ও দুধের চাহিদাও বেড়ে যায় অনেক।

বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) বিপণন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মাহফুজুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দুধ বিক্রি দ্বিগুণ হয়। মিষ্টি, টক দই ও মিষ্টি দইয়ের বিক্রিও বেড়ে যায়।'

ঈদের আগে সুগন্ধি চাল, মুরগি, গরু-খাসির মাংস, তেল ও মসলার চাহিদা বেড়ে যায়।

দেশের অন্যতম বৃহৎ পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদকে সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে। যেখানে প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার টন সয়াবিন তেল বিক্রি হয়, সেখানে ঈদের আগে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার টনে।'

অলঙ্কারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একটি জুয়েলারি দোকানের দৈনিক বিক্রি ৮০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে প্রায় তিন লাখ টাকায় দাঁড়ায় বলে জানিয়েছে দোকান মালিক সমিতি।

জনপ্রিয় ফার্নিচার ব্র্যান্ড হাতিল ফার্নিচারের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদে ফার্নিচার বিক্রি ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়।'

সবাই ঈদ উদযাপন করতে গ্রামে যান না। অনেকে যান পর্যটনকেন্দ্রে।

গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা'র নির্বাহী পরিচালক প্রদীপ সান্যাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সারা বছরের ব্যবসার বেশির ভাগই আসে ঈদের সময়। এ সময় ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ রুম বুকিং হয়ে যায়।'

Comments