ম্যান-মেড ফাইবারের পোশাক তৈরিতে বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্বসেরা

চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ এখন ম্যান-মেড ফাইবার বা কৃত্রিম সুতার বৈচিত্র্যময় পোশাক তৈরিতে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বসেরা হওয়ার পথে।

কৃত্রিম সুতা দিয়ে তৈরি পোশাক (এমএমএফ) এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কারণ বিদেশে এ ধরনের উচ্চ মূল্য-সংযোজিত পোশাকের বেশ চাহিদা আছে।

কৃত্রিম সুতার পোশাক আরও আরামদায়ক ও টেকসই হওয়ায় সুতির পোশাকের চেয়ে সেগুলোর দাম বেশি। কৃত্রিম সুতা থেকে তৈরি টি-শার্টের দাম প্রাকৃতিক তুলা থেকে তৈরি শার্টের প্রায় দ্বিগুণ।

ফলে দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকরা কৃত্রিম সুতার পণ্যে বৈচিত্র্য আনছেন।

কারখানার মালিকরা কৃত্রিম সুতার পোশাক উৎপাদন বাড়ানো ও পণ্য সরবরাহে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি গত ৫০ বছরে পোশাক পণ্যের গুণমান উন্নত করেছে।

এখন বিশ্ববাজারে সব ধরনের পোশাকের প্রায় সাত দশমিক নয় শতাংশ বাংলাদেশ থেকে যায়। আন্তর্জাতিক পোশাক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বাংলাদেশ নির্ভরযোগ্য স্থান।

দেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ২৯ শতাংশ কৃত্রিম সুতা দিয়ে তৈরি। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কৃত্রিম সুতার পণ্য নিয়ে বিশ্ব বাজারের মোট পোশাক চাহিদার ১২ শতাংশ মেটানোর লক্ষ্য নিয়েছে।

বিষয়টি মাথায় রেখেই আগামী ছয় বছরের মধ্যে দেশের বার্ষিক পোশাক রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলার করার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।

বিজিএমইএ সূত্র জানায়, এ প্রেক্ষাপটে স্থানীয় রপ্তানিকারকরা কৃত্রিম সুতার পণ্যের বাজার খোঁজার পাশাপাশি পণ্যের মূল্য সংযোজন বাড়াচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে দেশের রপ্তানিমুখী পোশাকে মূল্য সংযোজনের হার প্রায় ৭১ শতাংশ।

রপ্তানিকারকদের মতে, মূল্য-সংযোজিত দামের কারণে কৃত্রিম সুতার পোশাকের চালান ক্রমেই বাড়ছে।

কারণ কৃত্রিম সুতার পোশাকের জন্য বেশি অর্থ পাওয়া যায়। অনেক কারখানার মালিক কৃত্রিম সুতার একটি জ্যাকেটের দাম ১০০ ডলার পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।

গত মার্চে প্রকাশিত 'বিয়ন্ড কটন—অ্যা স্ট্র্যাটেজিক ব্লুপ্রিন্ট ফর ফাইবার ডাইভারসিফিকেশন ইন বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রি' শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী সুতার মোট উৎপাদনে কৃত্রিম সুতার অবদান ৭৮ শতাংশে পৌঁছেছে।

কৃত্রিম সুতার মোট উৎপাদনের প্রায় ৩৯ শতাংশ পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট ও ১৫ শতাংশ পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার।

যদিও নাইলন ফিলামেন্ট সুতা ও ভিসকস স্ট্যাপল ফাইবারের উত্পাদন বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী এর উৎপাদন মাত্র পাঁচ শতাংশ।

অন্যদিকে, অ্যাক্রিলিক স্ট্যাপল ফাইবারের বৈশ্বিক উৎপাদন ২০১৭ সালের এক দশমিক সাত শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে এক দশমিক চার শতাংশ হয়েছে। এদিকে, পশমি ও রেশমের বৈশ্বিক উৎপাদন যথাক্রমে এক শতাংশ ও শূন্য দশমিক এক শতাংশ।

পরিমাণের দিক থেকে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সুতার বাণিজ্য বার্ষিক প্রায় এক শতাংশ হারে বেড়েছে।

এই পাঁচ বছরে বৈশ্বিক বাণিজ্যে পলিয়েস্টার ফাইবারের চাহিদা বার্ষিক তিন শতাংশ হারে কমেছে। অন্যদিকে, পলিয়েস্টার সুতা ও কাপড়ের চাহিদা যথাক্রমে এক ও দুই শতাংশ বেড়েছে।

দেশে কৃত্রিম সুতার পোশাক উৎপাদন বেড়ে যাওয়া শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজার ধসের পর। এই মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী জানতে পারেন যে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা কী অসহনীয় পরিবেশে কাজ করেন।

এ দুর্ঘটনার পর অনেক আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা সরিয়ে নিতে চেয়েছিল। তখন অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড দেশের পোশাক কারখানাগুলোকে কিছু শর্ত দেয়।

সেই শর্ত অনুযায়ী পোশাক কারখানার মালিকরা কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা জোরদার করতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে। এর মধ্যে আছে আগুন নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামোগত ও বৈদ্যুতিক ঝুঁকি মোকাবিলা।

এটি যে শুধু বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা বাড়িয়েছে তা নয়, বরং এটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিশ্বে শীর্ষস্থানে এনে দিয়েছে।

বর্তমানে দেশে ২১৭টি এলইইডি সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা আছে। এর মধ্যে ৮৩টির মান প্লাটিনাম, ১২০টির গোল্ড ও ১০টির সিলভার। এ ছাড়াও, চার পোশাক কারখানাকে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল ছাড়পত্র দিয়েছে।

এসব বিনিয়োগের পর দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকরা কৃত্রিম সুতা দিয়ে আরও বেশি বৈচিত্র্যময় মূল্য সংযোজিত পোশাক তৈরি করতে পারছেন।

এর ফলে পরিবর্তিত ফ্যাশন জগতে কৃত্রিম সুতার ব্যবহার বেড়ে যায়।

পোলো ও মিক্সড ফাইবার থেকে তৈরি টি-শার্টের মতো সবসময় পরার মতো পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। গত এক দশকে অফিসের মতো আনুষ্ঠানিক পরিবেশে এসব পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।

এখন কৃত্রিম সুতার পোশাকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। দিনে দিনে এর চাহিদা বাড়ছে। চীন, ভিয়েতনাম ও ইতালি মতো পোশাক শিল্পের শীর্ষ দেশগুলো থেকে আসা মোট চালানের ৫০ শতাংশ কৃত্রিম সুতার।

তুলা উৎপাদনকারী ভারত ও তুরস্ক কৃত্রিম তুলার তুলনায় প্রাকৃতিক তুলার পোশাক বেশি রপ্তানি করে। বাংলাদেশে তুলা উৎপাদন নগণ্য হলেও প্রাকৃতিক তুলার পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বব্যাপী এর অবদান বেশি।

কৃত্রিম সুতার পোশাক রপ্তানিতে চীন শীর্ষ। বিশ্ববাজারে এর অবদান ৩৬ শতাংশ। ভারতের অবদান দুই শতাংশ ও বাংলাদেশের এক শতাংশ।

তবে কয়েক বছর আগে চীনের অবদান ৫৬ শতাংশ থাকলেও এখন তা কমছে। ভারতও কৃত্রিম তুলার পোশাক রপ্তানি কমিয়ে দিচ্ছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি উল্টো। বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম তুলার পোশাক বাণিজ্যে এ দেশের অবদান এক শতাংশেরও কম ছিল।

বিজিএমইএর সদ্য বিদায়ী সভাপতি ফারুক হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যদি পোশাক রপ্তানি থেকে আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে চাই, তাহলে ফাইবার বহুমুখীকরণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেননা, প্রাকৃতিক সুতার পরিবর্তে কৃত্রিম সুতার পোশাকের চাহিদা বাড়ছে।'

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে আরও দেখায় যে, কৃত্রিম সুতা আমদানি সম্প্রতি বেড়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, দেশের পোশাক কারখানার মালিকরা তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনছেন।

'তারপরও এ খাতের প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন' বলে মনে করেন তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে অবদান রাখতে তিনি কৃত্রিম সুতার পোশাক রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ফারুক হাসান আরও বলেন, 'তুলা বাংলাদেশের জন্যও অগ্রাধিকার। তবে বিশ্ববাজারে কৃত্রিম তুলার পোশাক তৈরি একটি উদ্ভাবনী ধারণা।'

একইসঙ্গে দেশের বাজারে কৃত্রিম সুতা বিক্রির ওপর তিন টাকা মূল্য সংযোজন কর তুলে নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

তবে কৃত্রিম সব পণ্যের মতো কৃত্রিম সুতা পরিবেশবান্ধব নয়। কেননা কৃত্রিম সুতা জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করা হয়।

মূলত পেট্রোকেমিক্যালের পলিমার থেকে এ ধরনের সুতা তৈরি করা হয়।

এ ছাড়াও, কৃত্রিম সুতা মাটিতে মিশে যায় না বলে তা পরিবেশ দূষণ করছে। কৃত্রিম সুতার কাপড় ধোয়ার সময় মাইক্রোপ্লাস্টিক বের হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, মহাসাগরে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ১৬ থেকে ৩৫ শতাংশ আসে কৃত্রিম সুতা থেকে।

এ ছাড়াও, কৃত্রিম সুতা ত্বকের জ্বালাপোড়া, অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যানসারসহ বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করে।

কিছু কৃত্রিম সুতা এমন রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে তৈরি করা হয়, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

7h ago