রপ্তানি তথ্যের গরমিল অর্থনীতির জন্যে অস্বস্তি

হঠাৎ এই তথ্যগত পরিবর্তনের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষও প্রায় নীরব, তাই উত্তরের চেয়ে এখন যেন প্রশ্নই বেশি!
স্টার ফাইল ফটো

আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যের গুরুত্ব বেড়েছে কয়েকগুণ। তথ্য দিয়ে যেমন মিথ্যা বলা যায়, আবার সত্যকে আরও সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায়। তবে তথ্য-সত্য-মিথ্যা এর মাঝখানে আরেকটি বিষয় আছে 'অর্ধসত্য'। যে তথ্য দিয়ে মিথ্যা বলা হচ্ছে না, আবার পুরোপুরি সত্য বলা হচ্ছে না- তা হলো অর্ধসত্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি তথ্যের গরমিল সংশোধন করেছে। এই সংশোধনী দরকার ছিল, কারণ তা ছিল অর্থনৈতিক অর্ধসত্য।

এ ধরনের অর্ধসত্য দেশের অর্থনীতির জন্য অস্বস্তিকর।

গত বুধবার বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের (বিওপি) নিয়মিত আপডেটের মাধ্যমে এই তথ্য সংশোধন করা হয়। এই ধরনের সংশোধনী দেশের অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা ও অর্থনীতিকে ঘিরে আবর্তিত নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

হঠাৎ এই তথ্যগত পরিবর্তনের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষও প্রায় নীরব, তাই উত্তরের চেয়ে এখন যেন প্রশ্নই বেশি!

তবে এটা স্পষ্ট হলো, রপ্তানি পরিসংখ্যানের সঠিক তথ্য সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পরিসংখ্যানগত ভুল অনেক অর্থনৈতিক সূচককে বিপর্যস্ত করতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) তার মধ্যে অন্যতম।

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি বলেন, এত বড় গরমিল 'অবিশ্বাস্য'।

তিনি বলেন, 'রপ্তানি ও আমদানি তথ্য গণনা একটি সহজ কাজ। কিন্তু কর্মকর্তাদের এ ধরনের বড় ভুল অর্থনীতির অন্যান্য উপাদানগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।'

'পুরো জিডিপির পূর্বাভাস পুনর্বিবেচনা করা উচিত,' মন্তব্য করেন তিনি।

এমকে মুজেরির কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেন অন্যান্য অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, 'সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি এই গরমিলের অনুপাত বৃদ্ধি পায়, তাহলে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।'

'কারণ এই তথ্য প্রকাশের সঙ্গে আরও কিছু বিষয় মাথায় আসে,' বলেন তিনি।

পরিসংখ্যানগত সংশোধনী থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় অবশেষে রপ্তানিকারকদের দাবি স্বীকার করে নিয়েছে। স্থানীয় রপ্তানিকারকরা বছরের পর বছর ধরে দাবি করে আসছেন, বিদেশে উল্লেখযোগ্য কোনো রপ্তানি আয় রাখা হয় না। অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি প্রাথমিকভাবে যা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়ে বেশি। এটি ইঙ্গিত দেয়, ২০২৭ সালের মধ্যে ১১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত নয়।

আশিকুর রহমান বলেন, 'অন্য কথায়, আমাদের এখন আরও বাস্তবসম্মত রপ্তানি কৌশল প্রণয়ন করা উচিত এবং প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করতে হবে।'

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি পরিসংখ্যানের মধ্যে ব্যবধান অন্তত ১২ বছর ধরে চলে আসছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ব্যবধান ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে এই গরমিলের কথা বললেও চুপ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘুম ভেঙেছে। তারা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ের গরমিল সমন্বয় করেছে। এই সমন্বয়ের ফলে, রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, যা পূর্বে প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখানো ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীত।

শুধু তাই নয়, বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে গার্মেন্টস পাওয়ার হাউস হিসেবে পরিচিত দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভুলে গেলে চলবে না, দেশের অর্থনীতির প্রায় ১০ শতাংশ পোশাক রপ্তানি থেকে আসে।

কিছু অনুমান এখন অপ্রাসঙ্গিক

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'এটি মারাত্মক তথ্য বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। কারণ অতীতে বাংলাদেশ যা অনুমান করেছে তা এখন 'অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক' হয়ে পড়েছে।'

শুল্ক বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো। পদ্ধতিগত কারণে হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক অনেক ক্ষেত্রে একই রপ্তানি তথ্য একাধিকবার বিবেচনা করে শুল্ক বিভাগ। এটি ডাবল বা ট্রিপল কাউন্টিং হিসেবে পরিচিত।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। তবে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সংশোধনের পর এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার।

অবশ্য কতদিন ধরে এ ধরনের ভুল তথ্য এন্ট্রি চলছে তা স্পষ্ট নয়।

সঠিক ও একটি ভালো নীতি প্রণয়ন নির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর নির্ভর করে। নিম্নমানের তথ্য নীতিনির্ধারকদের ভুল সংকেত দেয়।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'অনির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে নীতি প্রণয়ন করা হলে সেই নীতি অপ্রাসঙ্গিক ও অকার্যকর হয়ে পড়ে।'

'দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের অসঙ্গতির কারণে দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে,' বলেন তিনি।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়া সুচিন্তিত নীতি প্রণয়ন কঠিন।

তিনি আরও বলেন, 'রপ্তানি তথ্যের গরমিল জিডিপি পূর্বাভাসের ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ রপ্তানি থেকে মূল্য সংযোজন জিডিপি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। মূল্য সংযোজনের অনুপাত প্রায় ৬০ শতাংশ। ফলে জিডিপিতে ৬ বিলিয়ন ডলারের মতো প্রভাব পড়বে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. দ্বীন ইসলাম বলেন, 'এই সংশোধনের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমবে, সামগ্রিক অর্থনীতিতে রপ্তানির অবদান কমবে।'

তিনি বলেন, 'এই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক অংশীদারসহ অন্যান্য অংশীদারদের মধ্যে সাময়িক বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস তৈরি করতে পারে।'

তিনি মনে করেন, 'এ ধরনের সংশোধন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া অর্থনৈতিক তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।'

তার ভাষ্য, 'রপ্তানি তথ্যের সমন্বয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের আরও সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। এটি কার্যকর নীতি নির্ধারণ ও কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অর্থনীতির অধ্যাপক বিরুপাক্ষ পাল বলেন, 'বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের সঠিক হিসাব করার ক্ষেত্রে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।'

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা রপ্তানির তথ্য সরবরাহ করে না। সংস্থাটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক শাখা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রপ্তানির তথ্য সংকলন করে।

তিনি বলেন, 'পণ্য জাহাজীকরণের পরই আমরা রপ্তানি তথ্য দেখতে পাই। কোনো চালান ফেরত এলে তা খুঁজে বের করার সুযোগ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর নেই। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর মনিটরিং করে।'

তিনি আরও বলেন, 'তারপরও যদি কোনো তথ্য সংশোধনের প্রয়োজন হয়, আমরা তা করব।'

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি রয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে রপ্তানি ব্যুরো এখনো ২০২৪ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ের তথ্য প্রকাশ করেনি। যদিও সাধারণত প্রতি মাসের প্রথম দিকে প্রকাশ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'এখন থেকে সংশোধিত রপ্তানি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ হিসাব করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।'

বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মধ্যে আগের তথ্যের গরমিল নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'অতীতের তথ্য নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। রিপোর্ট করার পদ্ধতিতে সমস্যা ছিল।'

তবে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।

যাইহোক বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। এ ধরনের তথ্য সংশোধন মূলত অসঙ্গতিকে তুলে ধরে, অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন আনে না।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন রেফায়েত উল্লাহ মীরধামো. মেহেদী হাসান এবং প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)

Comments