যেমন ছিল ২০২৪

কম আয়ের মানুষের কাছে মূল্যস্ফীতি মানেই প্রতিদিনের লড়াই

মূল্যস্ফীতির চাপে দেশবাসী জর্জরিত। ছবি: স্টার ফাইল ফটো
মূল্যস্ফীতির চাপে দেশবাসী জর্জরিত। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

মূল্যস্ফীতির প্রভাব দেখা যায় সকালে নাস্তার টেবিলে। এক সময় যেসব পরোটা পুরু ছিল তা সময়ের পরিক্রমায় পাতলা হয়ে গেছে। সাধ-সাধ্যের এই ফারাক প্রতিদিনই স্পষ্ট হচ্ছে।

গত বছর তিন পরোটা ও এক প্লেট সবজির দাম ছিল ৩৯ টাকা। এখন খরচ হয় ৫০ টাকা। এই কারণে ক্রমবর্ধমান দামে সবচেয়ে ক্ষতিতে পড়েছেন দিনমজুর, প্রান্তিক কৃষক ও পরিবহন শ্রমিকসহ অল্প আয়ের মানুষেরা।

রাজধানীর মিরপুরের দুয়ারিপাড়া এলাকার ৪৫ বছর বয়সী রিকশাচালক মোফাজ্জল হোসেনের কাছে গত বছরও সকালের নাস্তা মানে ছিল ভাত ও সবজি। মাঝেমধ্যে এক টুকরো মাছ। এখন এক কাপ চা আর বিস্কুট।

প্রতিদিন তার আয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা থেকে কমে হয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। তার ছয় সদস্যের পরিবারকে চাহিদা অনুযায়ী খাওয়ানোই এখন চরম কষ্টের। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় তিনি বললেন, 'শেষ কবে মাংস খাইছি মনে নাই।'

মোফাজ্জলের দুর্দশা ঢাকা ও এর বাইরের মানুষের আরও দুর্দশার প্রতীক। কারওয়ান বাজারে ৩৮ বছর বয়সী দিনমজুর সাত্তার মিয়া এখন মাঝেমধ্যে খালি পেটে দিন শুরু করেন। তিনি এক সময় দৈনিক ৬০০ টাকা আয় করলেও এখন ৪০০ টাকা আয় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি মাঝেমধ্যে সকালের নাস্তা এড়িয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছেন।

মোফাজ্জল বলেন, 'মাঝেমধ্যে এগারোটার দিকে খাই। কখনোও এর পরে। কষ্ট হলে কী করার?'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে—গত জুলাইয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক এক শতাংশ। গত জানুয়ারিতে ছিল সাত দশমিক ৭৬ শতাংশ।

এসব সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে মানুষের কষ্ট। সাত্তার মিয়ার মতো যাদেরকে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় তাদের কষ্ট পরিসংখ্যান দিয়ে অনুভব করা যায় না।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষদের প্রতিটি দিন শুরু হয় বেদনাদায়ক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। যখন চিনি ও রান্নার তেলের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম ক্রমশ বেড়ে যায় তখন কী বাদ দেওয়া যায়? তাদের কাছে মূল্যস্ফীতি শুধু অর্থনৈতিক ঘটনা নয়, এটা টিকে থাকার লড়াই।

বরিশালের মুদি দোকানদার শম্ভুনাথ সাহা ডেইলি স্টারকে জানান, তার দোকানে বিক্রি কমেছে। যারা একসময় পাঁচ লিটার রান্নার তেল কিনতেন এখন তারা নেন এক বা দুই লিটার। যারা দুই কেজি চিনি কিনতেন তারা এখন কিনছেন এক কেজি।

তিনি বলেন, 'আগে যিনি এই দোকান থেকে দুই হাজার টাকার পণ্য কিনতেন এখন তিনি এক বা এক হাজার ২০০ টাকার পণ্য কিনছেন।'

অর্থনীতিবিদরা এর মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কম খাবার খেলে পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ে। শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও শিক্ষার ওপর দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব পড়ে।'

তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বেশকিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে আছে টাকার মান নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে নীতি হার বাড়ানো। গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি খরচ যৌক্তিকীকরণ ও কিছু নিত্যপণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক তুলে নেওয়া।

তিনি মনে করেন, মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি ও বাজারে পণ্যের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে। এর জন্য সময় ও আন্তরিক প্রচেষ্টা দরকার।

পণ্যের দামের অস্থিরতা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোকেও জর্জরিত করেছে। এসব দেশ খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে প্রায় পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে।

ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, 'বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করা ও বাজারে পণ্যের সহজলভ্যতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।'

কম আয়ের মানুষের বোঝা লাঘবে খোলাবাজারে নিত্যপণ্য বিক্রি ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথাও জানান এই বিশ্লেষক।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্যপণ্যের বেশি দামের কারণে গ্রামে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। ২০২৩ সালে মাথাপিছু দৈনিক গড় চাল খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৪১২ গ্রাম। ২০২২ সালে ছিল ৩৪৯ গ্রাম।

বিপরীতে, গরু ও খাসির মাংসের মতো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের ব্যবহার কমেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মাথাপিছু দৈনিক গড় খাসির মাংস খাওয়ার পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ২৮ গ্রাম। গরুর মাংস চার দশমিক শূন্য দুই গ্রাম। আগের বছর ছিল যথাক্রমে এক দশমিক ২৩ গ্রাম ও ১০ দশমিক ২৫ গ্রাম।

বিগত শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মূল্যস্ফীতি অব্যাহতভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় তা আরও খারাপ হয়েছে। গত আগস্টে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক চাপ আরও বেড়ে যায়।

ঢাকাতেও একই সংকট দেখছেন ফল বিক্রেতা নূর ইসলাম শেখ। এক বছর আগে যে আপেল প্রতি কেজি ১৮০ টাকায় বিক্রি হতো এখন দাম ৩০০ টাকা। আগে যিনি তিন কেজি আপেল কিনতেন তিনি এখন দুই কেজির জন্য দর কষাকষি করেন।

রাজধানীর বাইরের অবস্থা ভয়াবহ। দিনাজপুরের মাইক্রোবাস চালক সামিউল ইসলামের (৪০) মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা। খাবারের দাম ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় তার পরিবারের জীবনযাত্রার হিসাব বদলে গিয়েছে। তারা খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।

'বাচ্চারা যাতে খেতে পারে তাই নিজে মাঝেমধ্যে না খেয়ে থাকি।'

কুষ্টিয়ায় একই কথা বলেছেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক বাবুল কুমার আচার্য। তার পরিবার এখন ভাত, সবজি ও ডাল খেয়ে বেঁচে আছেন। মাংস দূরের অতীত।

কুষ্টিয়ার শিমুলিয়া গ্রামের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি মেহেদী হাসান প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটাতে ঘন ঘন ঋণ নিতেও হিমশিম খাচ্ছেন। তার ভাষ্য, 'এখন ছোটখাটো প্রয়োজনেও আত্মীয়-স্বজনের কাছে হাত পাততে হচ্ছে।'

ঢাকার তেজতুরী বাজারে রাস্তার ধারে ছোট খাবারের দোকান চালান লিটন ঘোষ। ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে ছোট ব্যবসায়ীরা কীভাবে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন তারই এক নিঃশব্দ প্রতিচ্ছবি তিনি।

লিটন বছর ক্রেতাদের কাছে ৩৯ টাকায় এক প্লেট সবজিসহ তিন পরোটা দিতে পারতেন। একই খাবারের দাম এখন তিনি নিচ্ছেন ৫০ টাকা। তাও আবার পরিমাণে কম।

তিনি বলেন, 'পরোটা এখন একটু ছোট, সবজির পরিমাণও আগের তুলনায় কমেছে।'

ডেইলি স্টারের দিনাজপুর সংবাদদাতা কংকন কর্মকার ও কুষ্টিয়া সংবাদদাতা আনিস মণ্ডল এই প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Air purifiers for Dhaka: hope or hype?

DNCC to set up 25-30 such industrial devices in public places to curb pollution; experts skeptical

19h ago