বাস-ট্রাক মালিকদের অগ্রিম কর বাড়ল, বাড়তে পারে পণ্যের দাম ও যাতায়াত ভাড়া

সরকার আগামী অর্থবছরে বাস, ট্রাক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক যানবাহন মালিকদের অগ্রিম আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এটি পরিবহন খরচের পাশাপাশি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
এই কর বেড়ে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত হবে। গত ছয় বছরের মধ্যে প্রথম এই কর বাড়ানো হলো। সর্বশেষ ২০১৯ ও এর আগে ২০১৪ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে এই কর হার পরিবর্তন করা হয়েছিল।
গত ২ জুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ নতুন কর হারের ঘোষণা দেন। এতে ১৩ ক্যাটাগরির বাস ও ট্রাকসহ বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত মোটরযানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে এই করের হার চার হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। নিবন্ধন বা ফিটনেস নবায়নের সময় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) মাধ্যমে প্রতিবছর তা আদায় করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখন তা সাড়ে সাত হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
পরিবহন মালিকরা বলছেন—এই কর বৃদ্ধির ফলে খরচ বাড়বে। পণ্যের দামে এর প্রভাব পড়বে।
তবে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন যে কর বাড়ানোর প্রভাব গাড়ির ভাড়ায় পড়ার কথা নয়। কারণ বছর শেষে গাড়ি মালিকদের মোট আয়করের সঙ্গে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) সামঞ্জস্য করা হয়।
কে কত টাকা দেবে
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুসারে—একটি ৫২-র বেশি আসনের বাসের অগ্রিম আয়কর ১৬ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হবে। এর কম আসনের বাসের ক্ষেত্রে আয়কর সাড়ে ১১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হতে পারে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে আয়কর সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হতে পারে।
দোতলা বাস ও এসি মিনিবাস বা কোস্টার মালিকদের আয়কর ১৬ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ২৫ হাজার টাকা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নন-এসি মিনিবাস বা কোস্টারের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত আয়কর সাড়ে ১২ হাজার টাকা।
প্রাইম মুভারের ওপর আয়কর ২৪ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ হাজার টাকা হতে পারে।
পাঁচ টনের বেশি ভার বহন ক্ষমতার ট্রাক, লরি ও ট্যাংক লরির আয়কর প্রায় দ্বিগুণ ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, ১৬ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা।
দেড় থেকে পাঁচ টন ওজনের যানবাহনের জন্য কর সাড়ে নয় হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং দেড় টনের কম ওজনের যানবাহনের কর চার হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত হাজার টাকা করা হতে পারে।
পিকআপ ভ্যান, হিউম্যান হলার ও থ্রি-হুইলারেরও অগ্রিম আয়কর বর্তমানের চার হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত হাজার টাকা করা হতে পারে।
এসি ট্যাক্সি ক্যাবের কর সাড়ে ১১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা ও নন-এসি ক্যাবের কর চার হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত হাজার টাকা করা হতে পারে।
আগামী ২২ জুন বাজেট পাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন হার কার্যকর হবে।
'সমস্যা হবে যাত্রীদের'
ক্রমবর্ধমান খরচ ও মুনাফা কমে যাওয়ায় পরিবহন মালিকরা ইতোমধ্যে সমস্যায় পড়েছেন। তাদের আশঙ্কা, কর বাড়ানোর প্রস্তাব অপারেটর ও যাত্রীদের খরচ বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর বাড়ানোর প্রস্তাব থেকে আমি এই বুঝেছি যে আয় না বাড়লেও খরচ বাড়বে।'
তার প্রশ্ন, 'খরচ বাড়ছে, কিন্তু ভাড়া বাড়ছে না। কীভাবে পোষাবো?'
'এই উদ্যোগ আমাদের জন্য আর্থিক ধাক্কা। এমনিতেই সমস্যায় আছি। এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমরা এ থেকে মুক্তি পাব না।'
তিনি জানান, আয়করের বিপরীতে পরে কর সমন্বয় হলেও ১০ থেকে ১৪ শতাংশ অগ্রিম করের টাকা আটকে রাখা হয়। অনেক ছোট অপারেটরের আয়ের অন্য উৎস নেই।
'এটি যাত্রীদের ওপর বাড়তি বোঝা তৈরি করবে। এ বিষয়ে সরকারকে চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাস মালিক তার হতাশার কথা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন।
তার ভাষ্য, 'আমরা জানি না কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বা এর পেছনে যুক্তি কী। কেউ আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেনি। কোনো বৈঠক নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। মনে হচ্ছে পুরো পরিবহন খাতকে এমন দোষের জন্য শাস্তি দেওয়া হচ্ছে যা আমরা করিনি।'
তিনি আরও বলেন, 'কর সংশোধনের এখতিয়ার রাজস্ব বোর্ডের আছে। তবে অতীতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তত অংশীদারদের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। এবার আমরা পুরোপুরি অন্ধকারে।'
'কেউ কি মূল্যায়ন করে দেখেছেন যে এটি যাত্রী বা মালিকদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে?'
রাজস্ব কর্মকর্তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজস্ব বোর্ডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছয় বছর ধরে কর হার অপরিবর্তিত থাকায় তা বাড়ানো যৌক্তিক। পরিবহন ব্যবসা রমরমা। সেই বিবেচনায় এই কর হার খুব বেশি না।'
তার মতে, 'যখন কর বেড়ে যায়, তখন মুনাফা কমে যেতে পারে। তাই পুরো দায় যাত্রী বা গ্রাহকদের ওপর চাপানো যৌক্তিক নয়।'
এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসার প্রকৃত কর যদি সংগৃহীত অগ্রিম করের তুলনায় বেশি হয় তবে তাদের করের বোঝা বাড়বে না।'
'তবে প্রকৃত কর কম হলে খরচ বাড়তে পারে। কারণ অগ্রিম কর ন্যূনতম কর হিসেবে কাজ করে। সেক্ষেত্রে মালিকরা বাড়তি খরচ যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে।'
Comments