শিল্পে উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু চাকরি কোথায়?

গত এক দশকে দেশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উৎপাদন। তবে কারখানার সংখ্যা ও উৎপাদন বাড়লেও সেই অনুপাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি, বরং কিছুটা কমেছে। এই ঘটনাকে 'কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি'র ধাঁধা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ সালে যেখানে দেশের কারখানাগুলোতে ১ কোটি ২১ লাখ মানুষ কাজ করত, ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২০ লাখে। অথচ এই সময়ে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্পের অবদান বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ২৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা ২০২৫-এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ৮১ শতাংশে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি দিয়ে চলা বড় বড় কারখানাগুলোই শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। এসব কারখানায় উৎপাদন বাড়াতে বেশি শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। ফলে জিডিপিতে শিল্পের অবদান বাড়লেও বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, তুলনামূলকভাবে কম কর্মী নিয়োগ করেও কিছু খাতে বেশি মূল্যের পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। এতে নতুন কর্মসংস্থান না হলেও জিডিপিতে বড় অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'গত দশকের শিল্প প্রবৃদ্ধি মূলত বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ছিল, ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প থেকে আসেনি। এই বড় শিল্পগুলো প্রযুক্তি-নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় চলে গেছে, এতে শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা কমেছে।'
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'যখন বাংলাদেশ ১০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করত, তখন যে পরিমাণ শ্রমিক কাজ করত, এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করেও তার চেয়ে কম শ্রমিক কাজ করছে। এর অর্থ হলো, আমরা উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়েছি এবং উৎপাদনশীলতা বেড়েছে।'
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঙ্গে একমত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কেএএস মুর্শিদও। তিনি বলেন, 'শুধু বিপুল জনসংখ্যা থাকলেই এখন আর কর্মসংস্থান তৈরি করা যায় না। অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা আগের মতো নেই। আমাদের এখন আধা দক্ষ, দক্ষ ও কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক দরকার, আর সেখানেই আমাদের ঘাটতি।'
তিনি আরও বলেন, 'বিআইডিএসের গবেষণায় আমরা দেখেছি, দেশে দক্ষ শ্রমিকের তীব্র সংকট রয়েছে। এ নিয়ে কিছু প্রকল্প থাকলেও তা যথেষ্ট নয়।'
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) জেনেভা কার্যালয়ের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, 'শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের এই নিম্নমুখী প্রবণতা হতাশাজনক। যেখানে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা, সেখানে উল্টো কমছে, আর কৃষিতে বাড়ছে।'
শ্রম অর্থনীতিবিদ নাজমুল হোসেন আভি বিষয়টিকে 'বি-শিল্পায়ন' ও 'অর্থনৈতিক বিচ্যুতির' প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, যদিও অটোমেশন ও নতুন প্রযুক্তি একটি কারণ হতে পারে, তবে শিল্প উৎপাদনে বৈচিত্র্যের অভাব কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা দিচ্ছে। দেশ কেবল সহজ বিকল্পগুলোর ওপর মনোযোগ দিচ্ছে।
তিনি বলেন, 'দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে।'
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, 'আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যা শেখাচ্ছে এবং শিল্পের যা প্রয়োজন, তার মধ্যে বড় ধরনের ফারাক রয়েছে। এ কারণে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে দক্ষ কর্মীরা এসে সেই সব পদে কাজ করছেন, যা বাংলাদেশি স্নাতকদের করার কথা ছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো হয়তো জরুরি ছিল, কিন্তু এটি বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা তৈরি করেছে। এই স্থবিরতা সরাসরি কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রভাব ফেলছে।'
রিজওয়ানুল ইসলাম শিল্পে কর্মসংস্থান কমার জেন্ডারভিত্তিক প্রভাব তুলে ধরে বলেন, 'ঐতিহ্যগতভাবে শিল্প খাত, বিশেষ করে পোশাকশিল্প নারীদের কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস ছিল। এই খাতে চাকরি কমে যাওয়া নারীদের জন্য মোটেও ভালো খবর নয়।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'সেবা খাত কখনোই শিল্প খাতের চাকরির বিকল্প হতে পারে না। সেবা খাতের অনেক চাকরিই কম উৎপাদনশীল ও নিম্ন বেতনের। এগুলো হয়তো মানুষকে টিকে থাকতে সাহায্য করে, কিন্তু দারিদ্র্য থেকে বের করে আনে না।'
Comments