পরিচালকদের মেয়াদ বৃদ্ধি ব্যাংক খাতের জন্য বড় ধাক্কা

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘পরিচালকদের ১২ বছর পদে থাকার অনুমতি দিলে ব্যাংকগুলোর সুশাসন দুর্বল হবে এবং খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।’
ব্যাংক, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহসান এইচ মনসুর, সালেহ উদ্দিন আহমেদ,

ব্যাংকের পরিচালকদের ১২ বছর পদে থাকার অনুমতি দেওয়ায় এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে ব্যাংক খাত সুশাসনের অভাবসহ একাধিক সংকটে ভুগছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'এই নিয়ম চালু হলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর পরিচালকদের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়বে।'

তিনি মনে করেন, 'ব্যাংক পরিচালকের মেয়াদ ৩ বছর বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল।'

এর আগে, গত ২১ জুন জাতীয় সংসদে শেষ মুহূর্তে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ বাড়িয়ে ১২ বছর করার বিধান রেখে 'ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল ২০২৩' পাস হয়।

গত ৮ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে যে বিলটির উত্থাপন করেন সেখানে ব্যাংকের বোর্ড সদস্যদের মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হয়নি। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও এ ধরনের কোনো সুপারিশ করেনি।

ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য আহসানুল হক টিটু সংসদে প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে সংশোধিত বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।

ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মনসুর বলেন, 'বিল সংশোধনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংসদ সদস্যদের ম্যানেজ করেছেন পরিচালকরা। মন্ত্রিপরিষদ, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা অর্থমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।'

আইএমএফের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'দেশে কোনো গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নেই। তাই, কোনো বিবেচনা ছাড়াই বিলটি পাস করা হয়েছে। আর জবাবদিহিতার এই অভাব জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে নেতিবাচকভাবে উন্মোচিত হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া খুবই বিরল।'

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'মনে হচ্ছে ব্যাংকের পরিচালকরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছেন। পরিচালকরা কার্যত খেলাপি। তারা বিভিন্ন সময়ে সরকারকে অনুদান দিয়ে থাকেন।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকটি তদন্তে জানা গেছে, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে একাধিক পরিচালক জড়িত ছিলেন।

'সরকার এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি কর্মসূচির আওতায় আছে। যেখানে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। কিন্তু, এই কর্মসূচিকে পাশ কাটিয়ে এই বিল সংশোধন করা হয়েছে,' বলেন তিনি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'পরিচালকদের ১২ বছর পদে থাকার অনুমতি দিলে ব্যাংকগুলোর সুশাসন দুর্বল হবে এবং খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ৩ মাসে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মন্তব্য করেন, 'সরকারের উচিত ছিল আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা, কিন্তু তারা পরিচালকদের সেবা করেছে। এর মানে তারাই দেশের প্রকৃত শাসক, কারণ তাদের হাতে এখন বিপুল ক্ষমতা।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'এ ধরনের উদ্যোগের ফলে আগামীতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হয়ে আসবে।'

তিনি আরও বলেন, 'একটি প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে নতুন নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সংশোধনীর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাত নতুন নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হবে।

তিনি প্রশ্ন করেন, 'একজন পরিচালক যদি টানা ১২ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তাহলে ব্যাংকিং খাতে নতুন নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি হবে?'

Comments