ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ অ্যাননটেক্সের প্রতি উদার জনতা ব্যাংক
গত ১৩ বছর ধরে ঋণের অর্থ ঠিকমতো ফেরত না পাওয়ার পরেও অ্যাননটেক্স গ্রুপের অতি নমনীয় আচরণ অব্যাহত রেখেছে জনতা ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকের শীর্ষ ৫ ঋণগ্রহিতার মধ্যে অন্যতম এই গার্মেন্টস কোম্পানিটি।
গত বছরের ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৭৪৬তম সভায় চলতি বছরের ১৫ জুনের মধ্যে ঋণের মূল অর্থ পরিশোধের শর্তে অ্যাননটেক্সকে ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি ১৯ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করা হয়।
অন্যথায় এই ঋণটি খেলাপি হিসেবে দেখানো হবে বলে বলা হয়।
২০২২ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের কাছে অ্যাননটেক্সের দেনার পরিমাণ ৭ হাজার ৭২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ৩৩৪ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক তাদের পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি অঙ্কের ঋণ কোনো গ্রাহককে দিতে পারবে না। জুন শেষে জনতা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।
অ্যাননটেক্স এই অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ তাদের ওয়েবসাইটে ব্রিটিশ ব্র্যান্ড টেসকো, নিউ লুক ও স্পেনের জারাকে ক্লায়েন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। একইসঙ্গে বার্ষিক টার্নওভার দেখানো হয়েছে ১৫০ মিলিয়ন ডলার।
সর্বশেষ গত ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত জনতা ব্যাংকের বোর্ডের ৭৭৮তম সভায় গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটিকে এ অর্থ ফেরত দিতে চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। অর্থাৎ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অ্যাননটেক্সের নাম ঋণখেলাপির তালিকায় উঠবে না।
তবে ব্যাংকটি এবার একটি নতুন শর্ত আরোপ করেছে। তা হলো—অ্যাননটেক্সকে তাদের দুটি কোম্পানি বিক্রি করে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোট দায়ের একটি অংশ পরিশোধ করতে হবে।
মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ঋণখেলাপি অ্যাননটেক্সের প্রতি এটিই জনতা ব্যাংকের নমনীয় আচরণের একমাত্র উদাহরণ নয়।
২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৩ হাজার ৫২৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক।
২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ঋণের সিংহভাগই জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে এবং এ ধরনের ঋণ সুদ মওকুফের মতো কোনো অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক জনতা ব্যাংককে একটি কার্যকরী নিরীক্ষা পরিচালনা এবং কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পাঁচ বছর পর গত জুলাইয়ে অডিট ফার্ম নিয়োগ দেয় জনতা ব্যাংক।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলেও মন্তব্য করতে রাজি হননি জনতার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আবদুল জব্বার।
জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যদি এই সুবিধা স্থগিত করি, তাহলে গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়ের জন্যই কোনো ইতিবাচক ফল আসবে না। কারণ আমাদেরকে তো ঋণের অর্থ ফেরত আনতে হবে।'
২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাংকটি চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন মাহফুজুর রহমান।
তিনি বলেন, সুদ মওকুফের মেয়াদ বাড়ানোর সময় ডাউন পেমেন্ট হিসেবে ইতোমধ্যে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণের একটি ছোট পরিমাণ পুনরুদ্ধার করা গেছে।
'তহবিলের ব্যয় পুনরুদ্ধার সাপেক্ষে সুদ মওকুফ করার বিধান রয়েছে। এই বিধান খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যবহৃত একটি মানসম্মত চর্চা।'
আননটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান ইউনুস (বাদল) বলেন, সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়ার সময় গ্রাহকদের দায় পরিশোধের জন্য এক বছর সময় দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের ছয় মাস সময় দেওয়া হয়েছে। সেই যুক্তিতে জনতা ব্যাংকের বোর্ড কর্তৃক সময় বাড়ানোর বিষয়টি ন্যায্য। আমরা আরও কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং তারাও জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে ইচ্ছুক।
তিনি জানান, তার কারখানাগুলো পুরোদমে চলছে।
'গত ১০ বছরে আমরা মাত্র চারটি কোম্পানির জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন পেয়েছি এবং বাকি ১৮টি কোম্পানি কোনো ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন সুবিধা পায়নি। এ কারণে আমরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সমস্যায় পড়েছি।'
অ্যাননটেক্স ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জমি বন্ধক রেখেছে বলেও জানান ইউনুস।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৮ সালের তদন্তে জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে কি না, জানতে চাইলে ইউনুস বলেন, 'জালিয়াতির বিষয়টি এখনো প্রমাণিত হয়নি।'
তবে শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্চ শেষে ২ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি থেকে যাওয়া জনতা ব্যাংকের এমন আর্থিক অবস্থার অন্যতম কারণ ঋণ সংশ্লিষ্ট অনিয়ম।
একসময় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত জনতার আর্থিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে মোড় নেয় অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে।
২০১৭ সালের শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকায়। গত মার্চ শেষে যা দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকায়, যা মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনতা ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, ঋণ পুনরুদ্ধারে দুর্বলতার কারণে ব্যাংকটি এখন তারল্য সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জবাবদিহিতার অভাবে জনতা ব্যাংক একটি অসুস্থ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি অনেকাংশে দায়ী।'
'এটা খুবই দুঃখজনক খবর যে, অ্যাননটেক্সের ঋণ অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ব্যাংক কর্তৃপক্ষ শাস্তি দেয়নি', যোগ করেন তিনি।
Comments