রেটিংয়ের ফাঁপা বুলিতে চাপা পড়েছিল ব্যাংকের দুর্নীতি

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

আর্থিক পরিস্থিতি নিয়মিত মূল্যায়ন ও সংকট সম্পর্কে আগেভাগেই সতর্ক করতে ব্যাংকগুলো বেশ কয়েকটি স্তরে কাজ করে থাকে। কিন্তু গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের পর ব্যাংকগুলোর ব্যাপক দুর্নীতির পাশাপাশি অনেক ব্যাংকের ভঙ্গুর পরিস্থিতি সামনে চলে আসে। এরপর সতর্ক করার দায়িত্বে থাকা স্তরগুলো নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।

সেই স্তরগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র পরিচালক ও অডিট ফার্ম থেকে শুরু করে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি পর্যন্ত অনিয়ম শনাক্তের দায়িত্বে থাকা পেশাজীবীদের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। তারা বছরের পর বছর ধরে খেলাপি ঋণ, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা তুলে ধরেনি, বরং অনেকক্ষেত্রে তারা বরং কৃত্রিমভাবে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখিয়েছে।

অনেকে স্বীকার করছেন যে এটি 'সম্মিলিত ব্যর্থতা'। এর মূলে আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা।

গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, বেশিরভাগ ব্যাংকের ব্যালান্সশিট 'কাল্পনিক', 'সাজানো তথ্যের ওপর নির্মিত'।

তিনি আরও বলেন, 'আমি যদি অডিট ফার্মগুলোকে তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে তাদেরকে বিচার করি, তাহলে কোনো যোগ্য অডিটর পাওয়া যাবে না।'

অডিট যে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারেনি, তার একটি উদাহরণ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। গত বছর অর্থ সংকটের কারণে ব্যাংকটি আমানতকারীদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছিল। এরপরও গত এক দশকে ব্যাংকটি দীর্ঘমেয়াদি ক্রেডিট রেটিং পেয়েছে 'এ+' ও স্বল্পমেয়াদি ক্রেডিট রেটিং পেয়েছে 'এসটি-২'।

ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে—'এ+' রেটিং ব্যাংকটির আর্থিক শক্তি ও 'এসটি-২' স্বল্পমেয়াদি রেটিং তথা উচ্চতর পারফরম্যান্স তুলে ধরে।

ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড এই রেটিং প্রকাশ করেছে।

ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়া সত্ত্বেও এর নিরীক্ষক শফিক বসাক অ্যান্ড কোং ও রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোং ২০২৩ সালে কোনো সমস্যার কথা জানায়নি। তারা বলেছে, ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে 'সত্য ও ন্যায্য দৃষ্টিভঙ্গি' দিয়েছে।

কিন্তু পরের বছর ব্যাংকটির সংকট দেখা দিলে সেই নিরীক্ষেই ৪৯ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতির কথা উল্লেখ করে ২০২৪ সালের রিপোর্টকে 'পরিষ্কার নয়'মত দেন।

অডিট প্রতিষ্ঠান দুইটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন ধরেননি। ব্যাংকের নিরীক্ষা নিয়ে পাঠানো ইমেলগুলো সম্পর্কে তারা উত্তরও দেয়নি।

ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. জামালউদ্দিন আহমেদের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। নির্বাহী চেয়ারম্যান এন কে এ মবিন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ফাঁপা রেটিংয়ে চাপা ছিল ব্যাংকের প্রকৃত তথ্য

একটি ব্যাংকের আর্থিক তথ্য যাচাইয়ের জন্য নিরীক্ষকদের প্রয়োজন হয়। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো তাদের মূল্যায়ন মূলত ব্যাংকের সেই নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করে।

ফার্স্ট সিকিউরিটির মতো একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে।

বছরের পর বছর ধরে এসব ব্যাংককে 'ভালো' অডিট রিপোর্ট ও উচ্চ রেটিং দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকগুলোয় খেলাপি বাড়লেও তা গত বছরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর জানা যায়।

বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপক অনিয়ম করে ঋণ দেওয়ায় সংবাদ শিরোনাম হয় দেশের সবচেয়ে বড় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ।

তবুও, অডিট রিপোর্ট বা ক্রেডিট রেটিংয়ে সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে, গুরুতর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ইসলামী ব্যাংক এর ক্রেডিট এজেন্সি থেকে সর্বোচ্চ সম্ভাব্য রেটিং 'এএএ' পেয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের রেটিং দিয়েছে ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড। আলফা রেটিং থেকে ইউনিয়ন ব্যাংক পেয়েছে 'এ+', গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে 'এএ-' ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে 'এএ+' রেটিং।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই তিন ব্যাংকই গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খায়।

আলফা রেটিং-এ ফোন করা হয়। গত ১৬ জুলাই ইমেইল পাঠানো হয়। উত্তর মেলেনি।

ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২০২৩ সালের নিরীক্ষা করা খান ওয়াহাব শফিক রহমান অ্যান্ড কোং ব্যাংক দুইটির আর্থিক অবস্থাকে 'সত্য ও ন্যায্য' বলে জানায়।

প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র পার্টনার মোহাম্মদ শহীদ ডেইলি স্টারকে জানান, নিরীক্ষা চলাকালে ঋণগুলো নিয়মিত দেখানো হয়েছিল। পরে সেগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ হয়।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রম নিরীক্ষা করি না। সঠিক রিপোর্টিংয়ের দায়িত্ব ব্যাংকের। সিস্টেমিক সাপোর্ট ছাড়া নিরীক্ষক একা কাউকে সতর্ক করতে পারে না।'

'অত স্বাধীন নয়'

আমানতকারী ও সাধারণ গ্রাহকদের স্বার্থ স্বতন্ত্র পরিচালকদের রক্ষা করার কথা। তারা ব্যাংকের তথ্য দেখতে পান। অন্যায় হলে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করবেন বলে আশা করা হয়।

যদি তারা সেই দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তবে প্রতিবাদ হিসেবে পদত্যাগ করতে পারেন। তারপরও অনেকে এখন বলছেন, বোর্ডের নির্দেশনা মেনে চলার জন্য তাদের ওপর চাপ ছিল।

স্বাধীন নিরীক্ষকদের ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র পরিচালক ড. জামালউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।

জনতা ব্যাংক এক সময় দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যাংক ছিল। কিন্তু অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের সঙ্গে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে এর আর্থিক সংকট বাড়তে শুরু করে।

আগের সরকারের আমলে তার ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনেক আপত্তি জানিয়েছিলাম, কিন্তু তারা ব্যবস্থা নেয়নি।'

কি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কোন বিষয় এই মুহূর্তে মনে নেই।'

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। সেই তদারকির অভাবও দেখা গেছে।

বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কমিশনের লোকবলের অভাব।'

তবে তিনি জানান, কিছু বিষয় এরই মধ্যে অডিট ফার্ম নিয়ন্ত্রণকারী ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলে (এফআরসি) পাঠানো হয়েছে। কয়েকজন স্বতন্ত্র পরিচালকের বিষয়ে পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।

জবাবদিহিতা যেন হারিয়ে না যায়

অডিটরদেরকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় 'প্রতিরক্ষার চতুর্থ লাইন' হিসেবে উল্লেখ করে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) প্রেসিডেন্ট এন কে এ মবিনের ভাষ্য, 'নিরীক্ষকরা আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করেন। তারা ব্যাপক যাচাইয়ের পরিবর্তে পেশাদারদের বক্তব্য ও নমুনা-ভিত্তিক মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করেন।'

অডিটের সময় যেসব সমস্যা দেখা যায় সেগুলো সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিবিধান অনুসরণ করে সমাধান করা হয়।

বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটস'র মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারকে অবশ্যই দোষীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় অডিট ও রেটিং বাবদ ফি দিলেও মানুষ সঠিক তথ্য পাবে না।'

একইসঙ্গে তিনি অডিটরদের ফি বাড়ানোরও কথা বলেন।

এফআরসির চেয়ারম্যান মো. সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কাউন্সিল ও বাংলাদেশ ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষকের ভূমিকা কী ছিল তা খুঁজে দেখছে।'

এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ হবে, তারপরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা করছেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Cashless society still a distant dream

Bangladesh’s goal of a cashless future is colliding with failed projects, user mistrust, and an economy that thrives on cash

14h ago