ই-কমার্স গ্রাহকরা এখনো ১২৭ কোটি টাকা ফেরত পাননি

ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষতিপূরণ চেয়ে মোট ৩৫ হাজার ৪৩৭টি অভিযোগ পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
প্রতীকী ছবি | স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক নথিতে দেখা গেছে, ২০২১ সাল থেকে পেমেন্ট গেটওয়েতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ১২৭ কোটি টাকা আটকে আছে।

সে বছর ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর ব্যাপক কেলেঙ্কারির তথ্য সামনে আসে। তখন একটি এসক্রো সিস্টেম চালু করেছিল সরকার। বিশেষ করে যেসব কোম্পানি গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েও পণ্য দিতে পারেনি তাদের জন্য।

জানা যায়, গত ১০ বছরে ই-কমার্সের আড়ালে দেশব্যাপী এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়েছে। ফলে হাজার হাজার মানুষ এখনো তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত পাননি।

অবশ্য অনেক ভুক্তভোগীরা আশা করেছিলেন সরকারের হস্তক্ষেপে তারা তাদের টাকা ফেরত পাবেন। কিন্তু পাননি। কারণ অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া বেশ ধীর গতির। তাই অনেকে গ্রাহক এখন বেশ হতাশ হয়ে পড়েছেন।

তেমনই একজন ফাহিম শাহরিয়ার। তিনি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের গ্রাহক। ফাহিম শাহরিয়ার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি ২০২১ সালের জুলাইয়ে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে দুটি ইয়ামাহা আর১৫ মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলেন। বাইক দুটির ন্যায্য বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা, তাই এই অফারটি তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল।

কিন্তু ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে পণ্য পাওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তিনি কোনো মোটরসাইকেল বা অর্থ ফেরত পাননি বলে জানান।

তিনি বলেন, 'টাকা ফেরত নিতে আমি বেশ কয়েকবার কিউকম অফিসে গিয়েছি। তারা প্রতিবারই টাকা ফেরত দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু আমি এখনো আমার টাকা ফেরত পাইনি।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিউকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রিপন মিয়া বলেন, 'এই টাকা ফেরত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র প্রয়োজন।'

তার ভাষ্য, 'আমি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন পেয়েছি, কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাইনি। এ কারণে পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিগুলো টাকা ফেরত দিতে পারেনি।'

এদিকে চলতি বছরের ১৯ মে পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকার বিষয়টি তদন্তে ৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষতিপূরণ চেয়ে মোট ৩৫ হাজার ৪৩৭টি অভিযোগ পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

এর মধ্যে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ১৬ হাজার ৬৬৭টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পেরেছে।

নথিতে দেখা যায়, এসক্রোতে সরকারের কাছে ৫৩৪ কোটি টাকা ছিল, যা থেকে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে ৪০৭ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়।

এসক্রো অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে এসক্রো এজেন্ট, যেমন বিকাশ, নগদ, সফটওয়্যার শপ লিমিটেড এবং কিছু ব্যাংকের পেমেন্ট গেটওয়ে।

ভোক্তা অধিকারের একজন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, রিফান্ড বিতরণের গতি এখনো বেশ ধীর।

'বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে, তাহলে গ্রাহকরা দ্রুত সময়ে টাকা ফেরত পাবেন,' বলেন তিনি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল ডিজিটাল কমার্স সেলের উপসচিব মোহাম্মদ সায়েদ আলী বলেন, অবিলম্বে ৮৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হতে পারে।

তিনি বলেন, 'কিছু কোম্পানি বর্তমানে চালু নেই, আবার কিছু কোম্পানি তাদের দেওয়া ঠিকানা থেকে পরিচালিত হচ্ছে না।'

তিনি আরও বলেন, 'কয়েকটি কোম্পানির মালিক পলাতক। তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করছে না, তাই আমরা গ্রাহকদের দাবি যাচাই করতে পারছি না।'

মোহাম্মদ সায়েদ আলী বলেন, পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিগুলো তাদের জানিয়েছে- রিফান্ড বিতরণে ধীরগতির মূল কারণ হলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের তালিকা দিতে দেরি করে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, পেমেন্ট গেটওয়েতে কতজন গ্রাহকের টাকা আটকে আছে তা শুধু কোম্পানিগুলো বলতে পারে।

ভোক্তা অধিকার সূত্রে জানা গেছে, পেমেন্ট গেটওয়েতে ৩৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের টাকা রয়েছে। এর মধ্যে কিউকমের আছে ৬১ কোটি টাকা ও ইভ্যালির ১৩ কোটি ৪ লাখ টাকা।

ইভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল দ্য ডেইলি স্টার, কিন্তু পারেনি।

অন্যদিকে আনন্দের বাজার, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, আকাশনীল, আলিফ ওয়ার্ল্ড, দালাল প্লাস ও থলের বিরুদ্ধে দায়ের করা অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।

ভোক্তা অধিকারের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৯ সালে অনলাইন শপ মুন্সীজির মাধ্যমে বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু হয়। ২০১০ সালের পরে ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সহজলভ্য হলে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

এতে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালে প্রতিযোগিতামূলক ই-কমার্স ব্যবসা শুরু হয়। কিন্তু কিছু কোম্পানি কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই এই ব্যবসা শুরু করে। তারা বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে অকল্পনীয় ছাড়সহ অন্যান্য অফার দিতে শুরু করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায়িক মডেলে ব্যাপক আকারে গজিয়ে উঠতে শুরু করে। তাতে শেষ পর্যন্ত গ্রাহকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

Comments