বাংলাদেশের কৃষিতে এল নিনোর প্রভাব

পূর্ব ও উত্তর গোলার্ধের দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও মে-জুনে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। জুনে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। চলতি মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।
জাতিসংঘ, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা, তাপপ্রবাহ, এল নিনো, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর,
পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে একজন কৃষক খেতে পানি দিতে বিদ্যুৎচালিত সেচ ব্যবস্থা ব্যবহার করছেন। তিনি আউশ ধান চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অর্থাৎ, উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বেশি হবে। ছবিটি বুধবার বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা থেকে তুলেছেন মোস্তফা সবুজ।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। জুলাইয়েও সেই ধারা অব্যাহত আছে।

পূর্ব ও উত্তর গোলার্ধের দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও মে-জুনে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। জুনে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। চলতি মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) জানিয়েছে, চলতি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৭ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।

চলমান এই আবহাওয়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কৃষিতে প্রভাব ফেলছে।

কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে তাপপ্রবাহ ও খরার কারণে আউশ ধান এবং কাঁচা মরিচসহ গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়নি। ফলে, দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল পাটের চাষেও এর প্রভাব পড়তে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের চরম আবহাওয়ার ঘটনা এমন সময়ে ঘটছে, যখন সমগ্র বিশ্ব এল নিনোর নতুন ধাপে প্রবেশ করেছে। এটি মধ্য ও পূর্ব গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার উষ্ণতার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি জলবায়ু প্যাটার্ন।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এল নিনো গড়ে প্রতি ২ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ঘটে এবং প্রত্যেকবার সাধারণত ৯ থেকে ১২ মাস স্থায়ী হয়ে থাকে।

এল নিনো ‍মূলত দক্ষিণ দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকার হর্ন এবং মধ্য এশিয়ার কিছু অংশে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে মারাত্মক খরা সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ এস এম কামরুল হাসান বলেন, 'এ অঞ্চলে এল নিনোর প্রভাবে কম বৃষ্টিপাত ও উষ্ণ তাপমাত্রার বৈশ্বিক পূর্বাভাস আছে।'

'আমরা বাংলাদেশেও এল নিনোর প্রভাব দেখতে পাচ্ছি,' বলেন তিনি।

সম্প্রতি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ঘরিয়া গ্রামের মরিচ চাষি ফেরদৌস আলম জানান, কম বৃষ্টি ও তীব্র তাপমাত্রার কারণে মরিচের পাতা কুঁকড়ে যায় এবং ফল পরিপক্ব হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে।

একই উপজেলার বিহারপুর গ্রামের কৃষক খাজা শেখ বলেন, 'এ বছর গরম আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করেছে।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ ফসল শাখার পরিচালক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, 'তাপদাহে ফুলের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া খরা ও কম বৃষ্টিপাত আউশ ফসলে প্রভাব ফেলেছে।'

তিনি জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ বছর ১৩.৯৫ লাখ জমি আউশ চাষের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ১০.৫৫ লাখ হেক্টর জমিতে এ ফসলের চাষ হয়েছে, যা আগের বছরের ১০.৬১ লাখ হেক্টরের তুলনায় কিছুটা কম।

তবে, কৃষকরা আগাম ফসল রোপণ শুরু করায় বৃষ্টিনির্ভর আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন পাটোয়ারী।

চলতি মৌসুমে আমন আবাদ ৫৫ লাখ হেক্টর থেকে বাড়িয়ে ৫৬ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। আমন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল, যা বার্ষিক ধান উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ।

উষ্ণ আবহাওয়া ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে অনেক কৃষককে জমিতে সেচ দিতে হয়েছে। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার শাহারকুড়ি গ্রামের কৃষক মোয়াজ্জেম হোসেন তেমনই একজন।

তিনি জানান, প্রতি বিঘা জমিতে আউশ চাষ করতে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হবে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি।

তিনি বলেন, 'নিয়মিত বৃষ্টিপাতের অভাবে এ বছর কীটপতঙ্গের আক্রমণের পরিমাণও বেড়েছে।'

শেরপুর উপজেলার কৃষক নায়েব আলী জানান, ঈদুল আজহার পর চাষের জন্য খেত প্রস্তুত করতে যে পরিমাণ বৃষ্টি পাতের প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। সেচ দেওয়ার পরও ফসলি জমি শুকিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবির বলেন, 'এল নিনো আবহাওয়ার প্যাটার্ন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আমরাও সেই প্যাটার্নে প্রবেশ করেছি। তবে, এল নিনো ও লা নিনা এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ নেই।'

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত একটি প্রকল্পের সমন্বয়ক যতীশ সি বিশ্বাস বলেন, 'প্রায় প্রতি বছরই তাপপ্রবাহ ও খরার মতো ঘটনা ঘটছে। এখানে প্রায় সারা বছর শিলাবৃষ্টি হয়, সামগ্রিক তাপমাত্রাও বাড়ছে, শীতকাল সংক্ষিপ্ত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত যথা নিয়মে হচ্ছে না এবং প্রয়োজনের সময় আমরা বৃষ্টি পাই না।'

২০২২ সালের আগস্টে এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বার্ষিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ০.০৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.০২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যতীশ সি বিশ্বাস এই গবেষণাপত্রের সহকারী লেখক।

এই দুই সময়কালে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২২৩ মিলিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ১.১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

যতীশ বলেন, 'আমরা যদি জলবায়ু সহিষ্ণু ধান সক্ষম ফসল উদ্ভাবন করতে না পারি, তাহলে সমস্যায় পড়ব। বিশেষ করে ঠান্ডা আবহাওয়ায় উৎপাদিত হওয়া গমের ক্ষেত্রে।'

Comments