অতিরিক্ত তাপে স্বাস্থ্যঝুঁকি, ভালো থাকার উপায়

যেহেতু আবহাওয়া বা তাপমাত্রা—কোনোটিই আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই, তাই কিছু বিষয় মানার মাধ্যমে নিজেদের নিরাপদে রাখা সম্ভব।
ছবি: রয়টার্স

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার ওপর। গত কয়েক দশকে আমরা এত বেশি তাপমাত্রা ও আর্দ্র আবহাওয়া আর কখনো পাইনি। বর্তমানে তাপমাত্রা প্রায়ই ৪১-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যাচ্ছে এবং অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে প্রায় ৪৪-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে করে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে অনেক বেশি, বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের জন্য।

মানুষের দেহের তাপমাত্রা ‍সাধারণত ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় হাইপোথ্যালামিক রেগুলেটরি সেন্টারের মাধ্যমে। মানবশরীরে সেলুলার মেটাবোলিজমের মাধ্যমে তাপ উৎপাদিত হয় এবং ভাসোডিলেশন ও ঘামের মাধ্যমে ত্বক দিয়ে তা বের হয়ে যায়।

শরীরের তাপমাত্রা কমার জন্য ঘাম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। আমরা যদি অনেক বেশি সময় ধরে এই গরম আবহাওয়ায় থাকি, তাহলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ঘটতে পারে—

তাপ অভিযোজন: গরম আবহাওয়ায় অভিযোজনে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। ঘাম বাড়তে থাকে, সেইসঙ্গে এতে থাকা লবণের পরিমাণ কমে যায়। বাড়তি বাষ্পীভবনের কারণে শরীর শীতল হয়।

তাপজনিত ব্যথা: গরম আবহাওয়ায় ব্যয়াম করার সময় কমবয়সী সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেও অনেক সময় পেশিতে ব্যথা কিংবা পা চাবানোর মতো সমস্যা দেখা যায়। এ ধরনের ব্যথাকে হিট ক্র্যাম্প বলে। এই গরমে পানিশূন্যতার পর যখন পুনরায় পানির চাহিদা পূরণ হয়, এর ফলে এই ক্র্যাম্প হয়ে থাকে—দীর্ঘ সময় ঘামে লবণ বের হয়ে যাওয়ার কারণে নয়। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় বাড়তি খাবার লবণ যোগ করে পানি ও লবণের সম্মিলিত ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ সম্ভব।

তাপজনিত অসুস্থতা (হিট এক্সোশন বা তাপজনিত ক্লান্তি): পরিবেশের তাপমাত্রা বেশি বেড়ে গেলে, বিশেষত উচ্চ আর্দ্রতার সময় বেশি ব্যয়াম করলে দেহের মৌলিক তাপমাত্রার আকস্মিক বৃদ্ধি ঘটতে পারে। দুর্বলতা, অবসাদ, মাথা ঘোরা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ও দেহের তাপমাত্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়া ইত্যাদি হচ্ছে তাপজনিত অসুস্থতার লক্ষণ। সোডিয়াম বা পানিশূন্যতার চাইতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়াটা এক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 
তাপজনিত এরকম অসুস্থতার ফলে 'হিট ইনজুরি'ও হতে পারে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাপের উৎস থেকে দূরে থাকতে হবে, ফ্যান বা কুলিং স্পঞ্জ দিয়ে শরীর শীতল করতে হবে। সম্ভব হলে অক্সিজেন মাস্কের ব্যবস্থাও করা যায়। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় লবণ ও পানির মাধ্যমে ওরাল রিহাইড্রেশন (ওআরএস) দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত অসুস্থ হয়ে পড়লে আইভি তরল ও আইসোটনিক স্যালাইন দেওয়ার দরকারও হতে পারে। সতর্ক পর্যবেক্ষণ জরুরি। একইসঙ্গে পটাশিয়ামের ঘাটতিও পূরণ করতে হবে।

হিট ইনজুরি (হিট স্ট্রোক): হিট ইনজুরি একটি তীব্র ও জীবনের জন্য ঝুঁকিজনক পরিস্থিতি, কেননা এতে করে শরীরের তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি হয়ে যায়। মাথাব্যথা, বমিভাব ও দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণও দেখা যায়। তীব্র মাত্রার হিট ইনজুরিতে যখন ত্বকের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তখন বেশিরভাগ সময় ঘাম হয় না। এতে করে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, খিঁচুনি ভাব, এমনকি কোমার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। গরম, আর্দ্র ও বায়ুবিহীন জলবায়ুতে হিট ইনজুরি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এমনকি ব্যয়াম না করলেও এমনটা হতে পারে।

বয়স্ক, ডায়াবেটিক রোগী এবং অ্যালকোহল, অ্যান্টিকোলিনার্জিকস, ডাই ইউরেটিক ও ফেনোথিয়াজিন জাতীয় নির্দিষ্ট কিছু ড্রাগ নিয়ে থাকেন—এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হিট ইনজুরির আশঙ্কা বেশি। হিট ইনজুরির ফলে হৃদরোগজনিত সমস্যা, ল্যাকটিক অ্যাসিডোসিস ও শিরা সংকোচনের মতো সমস্যা হতে পারে। এমনটা দেখা দিলে রোগীকে খুব কম সময়ের মধ্যে গরম স্থান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, আইস প্যাক দিয়ে তার গা মুছে দিতে হবে, খুব সতর্কতার সঙ্গে তরল পানীয় দিতে হবে, নয়তো পানিশূন্যতা হতে পারে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করালে রোগীর বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দেরি হলে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে, এমনকি প্রাণের ঝুঁকিও আছে। অতি তাপমাত্রা থেকে দূরে থাকা, বেশি পরিমাণে পানীয় গ্রহণ এবং সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করলেই হিট ইনজুরি রোধ সম্ভব।

এই সমস্যাগুলো কখনো কখনো প্রাণনাশকও হতে পারে। যদিও আবহাওয়া বা তাপমাত্রা, কোনোটিই আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই, তাই নিম্নোক্ত কিছু বিষয় মানার মাধ্যমে নিজেদেরকে নিরাপদে রাখা সম্ভব—

  • সরাসরি সূর্যের আলো এড়িয়ে চলা এবং বাইরে গেলে ছাতা বা টুপি ব্যবহার করা।
  • যথেষ্ট পানি পান করা এবং সবসময় পানির বোতল সঙ্গে রাখা।
  • শিশুদের স্কুলের বাইরে যাওয়া, খেলাধুলার বিষয়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা রাখা; ক্লাসরুমে যেন ভেন্টিলেশনের ভালো ব্যবস্থা থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা এবং প্রয়োজনমতো ফ্যান বা এসির ব্যবস্থা করা। শিক্ষার্থীদের বারবার পানি পানের বিষয়টি শিক্ষকদের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা।
  • বড়দেরকেও খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া এবং চাহিদানুযায়ী পানি পান করা।
  • আবাসিক এলাকার রাস্তাঘাটে পথচারী ও রিকশাচালকদের জন্য ছোট পানির ট্যাংকের ব্যবস্থা করা।
  • সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে তাদের আশপাশের এলাকায় পথচারীদের জন্য পানির বোতল বিতরণে উৎসাহিত করা।
  • হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে হিট স্ট্রোক বিষয়ে কার্যকর চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়া।

অধ্যাপক গোলাম নবী: জেড এইচ শিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments