শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর ‘গণতান্ত্রিক কৌশল’

প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রত্যাবর্তনের যে গল্প লিখে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা, তার পেছনের কারণ ও নীতিগুলো ঠিক কী কী?

মাত্র দেড় বছর আগেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জেরে প্রায় দেউলিয়া হতে বসা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার সার্বিক পরিস্থিতি এখন অনেক অনেকটাই স্থিতিশীল।

খাদ্য ও জ্বালানি সংকট কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন ঊর্ধ্বমুখী। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাদের মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছেছিল, সেখান থেকে গত আগস্টে তা ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

সেইসঙ্গে বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত দেশটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল, তার ৭৫ শতাংশ ইতোমধ্যে ফেরত দিয়েছে। অন্যান্য দেশ ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ঋণও একটু একটু করে পরিশোধ করে দিচ্ছে তারা।

এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রত্যাবর্তনের যে গল্প লিখে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা, তার পেছনের কারণ ও নীতিগুলো ঠিক কী কী?

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের ভাষ্য, দেশটির নতুন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি তাদের পরিস্থিতির এমন নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এর পাশাপাশি করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে পর্যটন খাতের ঘুরে দাঁড়ানো, কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয়টিও ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে।

তারা আরও বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ শ্রীলঙ্কার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও সংহত হয়েছে। ফলে, সরকার কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনস্বার্থের বিষয়টিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ সেখানে তৈরি হয়েছে। এ জায়গাটিতে দেশটির সাধারণ জনগণও সচেতন। তাই সংকট উত্তরণে তারাও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছে।

অথচ, কিছুদিন আগেই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে দেশটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা দেখেছিল বিশ্ব। এর পরিণতিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকার। উৎখাত হয়েছিলেন তিনিও।

অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক নীতি আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। তাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অত্যন্ত ভালো করছেন, ভালো নীতি নিচ্ছেন

দেশটি বৈদেশিক ঋণের ভারে এতটাই নুয়ে পড়েছিল যে তারা আর আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছিল না। ফলে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল খাদ্য, ওষুধসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের।

যে বিপর্যকর পরিস্থিতি থেকে এত অল্প সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর উদাহরণ তৈরি করল শ্রীলঙ্কা, তার পেছনের কারণগুলো সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক নীতি আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। তাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অত্যন্ত ভালো করছেন, ভালো নীতি নিচ্ছেন।'

তিনি বলেন, 'দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন কিংবা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দমনের মতো কোনো চেষ্টা আমাদের নেই। এ কারণে মূল্যস্ফীতির হার আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না, পুঁজিপাচার ঠেকাতে পারছি না, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও ঠেকাতে পারছি না।'

তার ভাষ্য, এখন যে মানুষগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন, নীতি গ্রহণের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন, তাদের দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে 'সুবাতাস' আসবে না। অর্থনীতি বোঝেন এমন মানুষদেরই এসব দায়িত্বে আনতে হবে।

আহসান এইচ মনসুর। ছবি: সংগৃহীত

আগের সরকারের ভুল নীতি ছিল। বলেছিল, সার আমদানি করবে না। সবকিছু জৈব সার দিয়ে করবে। ফলে, সেভাবে উৎপাদন হয়নি। এখন সার আমদানির ফলে তাদের কৃষিখাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে

দেড় বছর আগে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আইএমএফের সঙ্গে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি 'বেইল আউট প্যাকেজ' নিয়ে আলোচনা শুরু করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। গত মার্চে সেটি অনুমোদনও পায়। এরপর সামান্য হলেও খাদ্যমূল্য ও বিদ্যুতের দাম কমিয়ে জনজীবন সহজ করার চেষ্টা করে শ্রীলঙ্কা সরকার। সেইসঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার শুরু থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করে ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। জোর দেওয়া হয় বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর।

এ ছাড়া, ব্যয় সাশ্রয়ে চলতি বছরেও সব মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৬ শতাংশ করে কমিয়েছে রনিল বিক্রমাসিংহের সরকার। দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কমিয়ে অর্ধেকে আনার পরিকল্পনাও করা হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রীলঙ্কা কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। দেশটিতে সংকট হয়েছিল ২-৩টি কারণে। গভর্নেন্স সমস্যা তো ছিলই, কোভিডও একটা বড় সমস্যা ছিল। তারা পর্যটন নির্ভর দেশ। পর্যটকরা এখন ফেরত এসেছে, তাদের অবস্থানও একটু ভালো হয়েছে। আগের সরকারের ভুল নীতি ছিল। বলেছিল, সার আমদানি করবে না। সবকিছু জৈব সার দিয়ে করবে। ফলে, সেভাবে উৎপাদন হয়নি। এখন সার আমদানির ফলে তাদের কৃষিখাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।'

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থার তুলনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা কিছু করিনি। অর্থমন্ত্রীর কথা হচ্ছে অর্থনীতি ভালো আছে। এই মানসিকতা নিয়ে কাজ হওয়ার কথা না। এ জন্য তাদের মাইন্ডসেট বদলাতে হবে।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, গত জুলাইয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর আগে জুনে যা ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

তারও আগে গত মে মাসে সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা এর আগের ১৩৪ মাস বা ১১ বছর ২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সর্বশেষ জুলাইয়ে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হওয়ার মানে হলো, ২০২২ সালের জুলাই মাসে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনত, চলতি বছরের জুলাই মাসে একই পণ্য কিনতে তার খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৬৯ পয়সা। অর্থাৎ ১ বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৬৯ পয়সা। 

মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় একধরনের কর, যা ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার ওপর আরোপ হয়। তবে চাপে পড়ে মূলত সীমিত আয়ের মানুষ ওপর।

এ ব্যাপারে আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'যে অবস্থা চলছে, তাতে ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। জোড়াতালি দিয়ে সব চলছে। এভাবে এটা ঠিক করা যাবে না। মৌলিক পরিবর্তন দরকার।'

'সরকার সবসময় ইনফ্লেশন কার্ভের পেছনেই ছুটছে। এ ক্ষেত্রে কার্ভের সামনে থাকতে হবে, পেছন থেকে টেনে লাভ নেই। পেছনে পেছনে গেলে ইনফ্লেশন বাড়তে থাকবে,' যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

রাজাপাকশে প্রত্যাখ্যাত হলেন, তিনি একটা প্রশ্নের মুখে পড়লেন, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন—এটা হচ্ছে শ্রীলঙ্কার শক্তির জায়গা। শ্রীলঙ্কার মানুষ এটা করতে পেরেছে, কারণ তাদের সেই গণতান্ত্রিক অধিকার ও ইনস্টিটিউশনাল ক্যাপাসিটি ছিল।

বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শ্রীলঙ্কার 'সাফল্যের' কারণ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদের ভাষ্য, 'ওদের শক্তির জায়গা হচ্ছে, ওদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটা কাজ করে, ফাংশন করে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ওখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটাও চলছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা ও ট্রান্সপারেন্সির জায়গাও কাজ করছে। ফলে, বাংলাদেশের মতোই বড় বড় মেগা প্রকল্প বা ঋণ নিয়ে কাজ করা অথবা দুর্নীতির মতো কারণে তারা বিপদে পড়লেও সেখান থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। যারা এই কাজগুলোর সঙ্গে ছিল, তাদের প্রত্যাখান করা সম্ভব হয়েছে।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক বলেন, 'শ্রীলঙ্কার ওই ফাউন্ডেশনটা বাংলাদেশের চাইতে অনেক শক্তিশালী। অনেক বেশি ডেমোক্রেটিক। সেটাই শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করেছে সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে।'

তিনি বলেন, 'জনগণের সুবিধার বিষয়টি ওখানকার রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছে। সুতরাং এটাও ওখানে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে।'

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, 'রাজাপাকশে প্রত্যাখ্যাত হলেন, তিনি একটা প্রশ্নের মুখে পড়লেন, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন—এটা হচ্ছে শ্রীলঙ্কার শক্তির জায়গা। শ্রীলঙ্কার মানুষ এটা করতে পেরেছে, কারণ তাদের সেই গণতান্ত্রিক অধিকার ও ইনস্টিটিউশনাল ক্যাপাসিটি ছিল।'

'ওদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। এখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেখা যায়, যারা টাকা পাচার করছে, তাদের পক্ষেই কাজ করছে। কিংবা যারা ঋণখেলাপী, তাদের পক্ষেই কাজ করছে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এটা করতে হয়নি। তারা জনগণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে পেরেছে,' যোগ করেন তিনি।

Comments