ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কা, এখনো হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঝুঁকি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা।
আইএমএফ জানিয়েছে, তাদের নির্বাহী বোর্ড শ্রীলঙ্কার বেলআউট প্যাকেজের প্রথম ধাপের পর্যালোচনা শেষ করেছে (যা সম্প্রসারিত তহবিল সুবিধা নামে পরিচিত) এবং ৩৩৭ মিলিয়ন ডলারের দ্বিতীয় কিস্তির অনুমোদন দিয়েছে।
এমন সময়ে শ্রীলঙ্কা আইএমএফের ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বেলআউটের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে যাচ্ছে, যখন দ্বীপ রাষ্ট্রটি তাদের বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ চীনের সঙ্গে একটি ঋণ কাঠামো পরিকল্পনায় পৌঁছেছে।
আইএমএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেনজি ওকামুরা ঋণের কিস্তি অনুমোদনের পর গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, 'শ্রীলঙ্কার সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির সংস্কার ফলপ্রসূ হতে শুরু করেছে। দেশটির অর্থনীতি স্থিতিশীলতার লক্ষণ দেখাচ্ছে- যেমন দ্রুত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ উল্লেখযোগ্য রাজস্বভিত্তিক আর্থিক সমন্বয় ও রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।'
খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা শেষ হয়ে যাওয়ায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশটি গত বছর ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ খেলাপি হয়।
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে ঢাকা কলম্বোকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। পরে তাদের রিজার্ভের উন্নতি হওয়ায় পুরো অর্থ পরিশোধ করেছে।
এদিকে আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের ৬৮৯ মিলিয়ন ডলারের দ্বিতীয় কিস্তির চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ দুটির জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে গত ১২ ডিসেম্বর আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড দুই দেশের জন্য দ্বিতীয় কিস্তির অনুমোদন দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা রাজস্ব বাড়াতে ও রিজার্ভ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশ এখনো উভয় মানদণ্ড পূরণে লড়াই করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি একাধিক কারণে সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেনে-রাশিয়ার যুদ্ধ ও বৈশ্বিক আর্থিক অস্থিতিশীলতা করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া কঠোর আমদানি সংকোচন নীতির কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি যথেষ্ট সংকুচিত হয়েছে।
তবে, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও নীতিগত কারণে আর্থিক হিসাবের নজিরবিহীন পরিবর্তন রিজার্ভ ও টাকাকে চাপের মধ্যে রেখেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে। কারণ দেশটি সুদের হার বাড়িয়েছে ও নমনীয় করেছে।
২০২২ সাল শেষে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫৪ শতাংশ। অথচ ২০২৩ সালে যা ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এছাড়া রিজার্ভ গত বছরের ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালে আনুমানিক ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, 'মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে শ্রীলঙ্কা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশ ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।'
এছাড়া, এক সময় শ্রীলঙ্কা বিনিময় হার পরিচালনা করত। পরে তা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে, বিনিময় হার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।
একইসঙ্গে শ্রীলঙ্কা আর্থিক খাতের দুর্বলতাগুলোও মোকাবিলা করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এ খাতের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করলেও ২০২৫ সালের মার্চ মাস থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু হবে। আবার বাংলাদেশের ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাত কেলেঙ্কারির কারণে ইতোমধ্যে খারাপ অবস্থায় আছে।
জাহিদ হোসেন প্রশ্ন তোলেন, 'বিধিমালা বাস্তবায়নের জন্য কেন অপেক্ষা করা হচ্ছে?'
একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হলো সুদের হার বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন বছর পর চলতি বছরের জুলাইয়ে সুদের সীমা থেকে সরে গেছে। সরকারের ঋণও কমেছে।
তিনি আরও বলেন, 'সরকারি ঋণের পতনের ধারা অব্যাহত থাকবে কি না তা নিয়ে আলাদা আলোচনা, তবে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য এটি ভালো সংকেত।'
তবে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিনিময় হার নমনীয় করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেখানে খুব বেশি কিছু করা হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশ এবং আইএমএফ আশা করছে চলতি অর্থবছরে তা ৭ দশমকি ৯ শতাংশে নেমে আসবে। তবে, তা নির্ভর করবে সংস্কারের ফলাফলের ওপর।
জাহিদ হোসেন বলেন, শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় মুদ্রানীতির মাধ্যমে শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে, যদিও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দেরি করে ফেলেছে এবং এখনো যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাফেদা (বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন) ও এবিবিকে (অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ) রেট নির্ধারণের অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশ বিপরীত দিকে এগোচ্ছে।
'এই সিস্টেম একেবারেই কাজ করছে না,' বলেন তিনি।
তার মতে, 'এতে বাজারে একটি বিশৃঙ্খল বিনিময় হার বিরাজ করছে। নেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। সবাই অফিসিয়াল রেটে রিপোর্ট করছে, কিন্তু আসল হার অনেক বেশি এবং কোনো শৃঙ্খলা নেই।'
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সংস্কার উদ্যোগের কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, 'শ্রীলঙ্কার গভর্নর রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিলেন না এবং তিনি পেশাদার ও কার্যকরভাবে নীতিগত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ফলে, অর্থনীতি দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যদিও দেশটি এখনো পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।'
'অন্যদিকে যেহেতু বাংলাদেশ সরকার সংস্কার আনতে দেরি করছে, তাই ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো দৃশ্যমান লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না,' বলেন তিনি।
এছাড়া ব্যাংকিং ও রাজস্ব খাতে এবং হুন্ডি ও অর্থপাচার বন্ধে কোনো সংস্কার দৃশ্যমান নয়, যা বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্যও দায়ী।
তিনি আরও বলেন, 'বলা হচ্ছে নির্বাচনের পর সংস্কার কাজে গতি আনা হবে, কিন্তু আর দেরি করার সুযোগ নেই।'
(প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)
Comments