শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি

চলতি বছরের নভেম্বরে গ্রামাঞ্চলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, যা জাতীয় গড় ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশের চেয়ে বেশি। বিপরীতে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি, খাদ্য মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো,
রাজধানীর একটি মুদি দোকানের সাধারণ দৃশ্য। স্টার ফাইল ফটো

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শহরের মানুষের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত মানুষকে খাদ্য পণ্যের জন্য বেশি ব্যয় করতে হয়েছে।

বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৩৫ মাসের মধ্যে ৩১ মাস দেশের গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি শহর ও উপশহর অঞ্চলের চেয়ে বেশি ছিল।

গ্রামীণ অঞ্চলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ খাদ্যমূল্য। যদিও বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামে বাস করেন এবং এসব গ্রাম থেকেই দেশের চাল, শাকসবজি, মাছ ও হাঁস-মুরগির বেশিরভাগ সরবরাহ আসে।

চলতি বছরের নভেম্বরে গ্রামাঞ্চলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, যা জাতীয় গড় ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশের চেয়ে বেশি। বিপরীতে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।

সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল করিম জানান, গত এক বছরে তার মাসিক খরচ ছয় থেকে সাত হাজার টাকা বেড়েছে। তাই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

তিনি বলেন, 'বাজারে শীতকালীন সবজি আসতে শুরু করেছে, কিন্তু দাম এখনো বেশি।'

৩৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি জানান, কয়েক বছর আগেও তিনি ৫০ কেজি চালের বস্তা এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায় কিনতে পারতেন। অথচ এখন একই পরিমাণ চালের দাম দুই হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ৯০০ টাকা।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশে, যা শহরাঞ্চলে ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মানুষ অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এতে গ্রামীণ বাজারে পোশাক ও অন্যান্য পণ্যের খুচরা বিক্রয়ে প্রভাব পড়েছে।

বাগেরহাটের শহরতলির বাজার গিলাতলার গার্মেন্টস ও শীতবস্ত্রের খুচরা বিক্রেতা ফকির আলাউদ্দিন শাইব বলেন, এখন কাপড়ের পেছনে অতিরিক্ত ব্যয় করার মতো যথেষ্ট আয় মানুষের নেই।

তিনি বলেন, 'গত বছরের একই সময়ে শীতবস্ত্র ভালো বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু, এ বছর তেমন বিক্রি নেই।'

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বাসিন্দা স্বপন মির্জা বলেন, 'শহর ও গ্রামে খাদ্যসামগ্রীর দাম প্রায় একই রকম। কিছু ক্ষেত্রে শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি।'

এক সপ্তাহ আগে বিআইডিএসের বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষকের উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে বলা হয়, উচ্চমূল্যের প্রেক্ষাপটে এক শ্রেণির মানুষ দারিদ্র্য সীমার মধ্যে পড়ছে।

আইএফপিআরআই বলছে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও করোনা পরবর্তী প্রভাবের কারণে ২০২২ সালে কমপক্ষে ২৭ লাখ ৫১ হাজার বাংলাদেশি দারিদ্র্য সীমার মধ্যে পড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দা বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে এবং এ বছরও ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে।

নতুন দারিদ্র্যের মধ্যে পড়া বেশিরভাগ মানুষই গ্রামীণ এলাকার বলে এতে বলা হয়।

বিবিএসের গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, জাতীয়ভাবে ২০২২ সালে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে এ হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ।

গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি কেন?

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, 'এর কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই।'

'গ্রামাঞ্চলের বৈচিত্র্যময় খাদ্য উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে অবদান রাখতে পারে,' বলেন তিনি।

গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার ভোক্তা মূল্য সূচক গণনা করতে বিবিএস দুই সেট পণ্য (পণ্য ও পরিষেবা) ব্যবহার করে। গ্রামীণ সেটে ৩১৮টি পণ্য এবং শহুরে সেটে ৪২২টি পণ্য থাকে।

অধ্যাপক কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, সরবরাহের ঘাটতি দাম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। কারণ কৃষকরা শহর ও শহরাঞ্চলে সরবরাহ করা পণ্য বেশি দামে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করে।

অর্থনীতিবিদ ও জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিসের কর্মসংস্থান খাতের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, গ্রামাঞ্চলের খাদ্য মূল্যস্ফীতি শহরাঞ্চলকে ছাড়িয়ে যাওয়া বিপরীতমুখী।

'এর কারণ হলো সেখানে ব্যবহৃত বেশিরভাগ খাদ্য পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বলে ধারণ করা হয় এবং শহুরে খাদ্য পণ্যের তুলনায় কেন সেগুলোর দাম দ্রুত হারে বেড়েছে তা বোঝা মুশকিল।'

তবে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানান তিনি।

প্রথমত, সময়ের সঙ্গে ব্যবহারের ধরণ পরিবর্তিত হতে পারে, তাই প্রচলিত ধারণাও আর সঠিক নাও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ অঞ্চলে শহরের তুলনায় বেশি পরিমাণে সরবরাহ বাধার মুখে পড়তে পারে, এতে দাম বৃদ্ধির উচ্চ গতি দেখা দিতে পারে।

'এসব বাধা পরিবহন খরচ থেকে শুরু করে মহাসড়কে চাঁদাবাজি পর্যন্ত হতে পারে,' মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন অবশ্য মনে করেন, উৎপাদনকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সুফল পাওয়া যায়। কারণ তারা ভালো দাম পায় এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে।

তিনি বলেন, 'মূল্যস্ফীতি বাড়লে আমরা সাধারণত ভোক্তাদের দিক নিয়ে আলোচনা করি, কারণ তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'

ইউনিভার্সিটি অব টোকিওর রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ আবদুল মালেক বলেন, 'আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির দিকে তাকান, তাহলে একই ধরনের দৃশ্য দেখতে পাবেন। মূলত পরিবহন জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণ এমনটা ঘটেছে।'

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চালের দাম বৃদ্ধির কারণে এটি হতে পারে। কারণ এটি খাদ্য তালিকায় বড় একটি অংশ দখল করে আছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় এক বছর পর মোটা চালের দাম কেজিতে ৫০ টাকা অতিক্রম করেছে।

বিবিএসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পরিসংখ্যান সংস্থা মূল্যের তথ্য সংগ্রহ করে ও মূল্যস্ফীতি গণনা করে। কিন্তু, এই পরিসংখ্যানের পেছনের কারণ খুঁজে বের করার জন্য তাদের কোনো গবেষণা শাখা নেই।

সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, শুধু খাদ্য মূল্যস্ফীতি নয়, গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে।

তিনি জানান, প্রবাসী আয় ও গ্রামীণ জনগণের বৈচিত্র্যময় আয় বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামের খুচরা দোকান, রেস্তোরাঁ ও বড় বাজারগুলোর বৃদ্ধি তার প্রমাণ।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম বা এলাকা নেই, যেখানে প্রবাসী আয় আসে না।'

Comments