বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ: ৩ বছরে পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে ৬৩ শতাংশ

গত অর্থবছরে সরকার ২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে

সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ গত অর্থবছর থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা দেশের কোষাগারের ওপর নতুন করে চাপ বাড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বৈদেশিক ঋণ বিতরণ এবং তার বিপরীতে সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি ঋণ পরিশোধের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে তুলছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদসহ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারে। গত অর্থবছরে সরকার ২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়ে ৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশ ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫১ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ ১৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬২ মিলিয়ন ডলারে।

প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, সরকার ২০২৪-২০২৫ সালে বৈদেশিক ঋণ হিসাবে ৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশের বকেয়া বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছে বাংলাদেশের ঋণের ৫৯ শতাংশ পাওনা আছে। বাকিটা দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছে।

ঢাকা মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে তাদের তহবিল বরাদ্দ বেড়েছে।

এ ছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করতে উন্নয়ন অংশীদাররা ঋণ দেওয়া ত্বরান্বিত করায় গত তিন বছরে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য বাজেট সহায়তা পেয়েছে।

ফলে ঋণ পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে।

ঋণের মেয়াদ পূর্তির পর মূল অর্থের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়, যার মেয়াদ ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঋণ বিতরণের পর সুদ পরিষেবা শুরু হয়।

গত ১৫ বছরে রাশিয়া, ভারত ও চীন বাংলাদেশের প্রধান ঋণদাতা হিসেবে উঠে এসেছে।

বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছে সরকারের ঋণের পরিমাণ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। প্ল্যান্টের একটি ইউনিটের নির্মাণ কাজ এ বছরের মধ্যে শেষ এবং অন্য ইউনিটটি ২০২৫ সালের মধ্যে প্রস্তুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঋণের বর্ধিত সময় শেষ হবে ২০২৫-২০২৬ সালে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকার এখন ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩৩০ মিলিয়ন ডলার।

মূল অর্থ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬-২৭ সালে। সেই বছরে ৫৩১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২৭-২৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ হবে ৫১৯ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৮-২৯ সালে ৫০৭ মিলিয়ন ডলার।

এর পরে, বার্ষিক পরিশোধের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমবে।

চীনা ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতি বছর ২৫১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করছে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে তা ৬৯৮ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন, সরকারের বেশির ভাগ ঋণ বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে আসে এবং তা ছাড়ের শর্তের ওপর ভিত্তি করে আসে।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বাংলাদেশের একটি বৈদেশিক ঋণ সূচক ছাড়া সবগুলোই প্রান্তিক সীমার নিচে অবস্থান করছে।

তবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ এখনো স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে। তবে কিছু ঝুঁকি রয়েছে যা আইএমএফের সর্বশেষ ঋণ টেকসই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের রপ্তানি খাত বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়লে ডলারের মজুদ কমে যাবে। 'সেক্ষেত্রে ঋণ কম থাকলেও ঋণ পরিশোধে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।'

বাংলাদেশের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কম রাজস্ব আদায়। দেশটি বিশ্বের সর্বনিম্ন ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাতগুলোর মধ্যে একটি।

যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে তবে ঋণ পরিশোধ একটি বোঝা হয়ে উঠতে পারে কারণ সরকার ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় কমাতে বাধ্য হবে।

জাহিদ হোসেন বলেন, ভবিষ্যতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের উচিত বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে কম সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করা।

'এজন্য লাভজনক প্রকল্প থাকতে হবে।'

সরকার যদি বাণিজ্যিক ঋণের জন্য যায়, তবে তহবিল এমন প্রকল্পের জন্য হওয়া উচিত যা সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, তিনি বলেন।

'এছাড়া, প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করতে হবে। প্রকল্পগুলো শেষ হওয়ার আগেই ঋণ পরিশোধ শুরু হলে তা দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।'

Comments