জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নে করপোরেট মুনাফা ২০ শতাংশ কমেছে

৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে ১৬৭টি কোম্পানির মধ্যে ১৬টি নতুন করে লোকসানে পড়েছে। ১৮টির লোকসান আগের তুলনায় বেড়েছে এবং ৭০টি কোম্পানির মুনাফা কম হয়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সুদহার বৃদ্ধি, ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন, স্কয়ার, বেক্সিমকো, ওয়ালটন, পদ্মা অয়েল,
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কঠিন সময় পার করছে। এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেমন করেছে তাই নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব। শেষ পর্বে আমরা তুলে ধরব বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা, বিক্রি ও মুনাফার তথ্য।

আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মূলত টাকার অবমূল্যায়ন ও উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের কারণে বিক্রি বেশি হলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বার্ষিক মুনাফা কমেছে। এই কমার হার ২০ শতাংশ।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ১৬৭টি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে এই কোম্পানিগুলোর সমন্বিত বিক্রি ১০ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ২১ হাজার ১৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু, বিক্রি বাড়লেও সার্বিক মুনাফা কমেছে। এসব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুনাফা ২০ দশমিক ৮ শতাংশ কমে ৮ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

তবে, দ্য ডেইলি স্টারের বিশ্লেষণে বহুজাতিক কোম্পানি, ব্যাংক, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিমা কোম্পানিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কারণ তাদের আর্থিক বছর শেষ হয় প্রতি বছরের ডিসেম্বরে।

৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে ১৬৭টি কোম্পানির মধ্যে ১৬টি নতুন করে লোকসানে পড়েছে। ১৮টির লোকসান আগের তুলনায় বেড়েছে এবং ৭০টি কোম্পানির মুনাফা কম হয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের সভাপতি ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, 'তালিকাভুক্ত হোক বা না হোক বেশিরভাগ কোম্পানিরই মুনাফা কমেছে।'

তিনি মনে করেন, এর অন্যতম কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে চাহিদা কমে যাওয়া।

বাংলাদেশে মূলস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

তিনি বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় মানুষ ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে, যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এছাড়া বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার কারণে রপ্তানি বাজারেও পণ্যের চাহিদা কমেছে।'

এর মধ্যে গত অর্থবছরে রিজার্ভ ধরে রাখতে বিদেশি লেনদেন সীমাবদ্ধ করার পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।

একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। তাই বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলোর সংকট বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ১৬ দশমিক ১২ শতাংশ কমে ১০৯ টাকায় নেমেছে।

সবমিলিয়ে গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। এই দুর্বল টাকা ও শক্তিশালী ডলার বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেশ বাড়িয়েছে।

অন্যদিকে সরকার রিজার্ভ ধরে রাখতে ও ভর্তুকি কমাতে দাম সমন্বয় করার পর জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বেড়েছে পরিবহন খরচও।

এই সময়ে বিদ্যুতের দাম তিন ধাপে ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হয়, ফলে প্রায় ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হয়েছে। ডিজেলের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। দেশে ব্যবহৃত সব ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য তৈরিতে ৭০ শতাংশ ডিজেল ব্যবহার হয়।

বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়েছে ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ। একইভাবে গত অর্থবছরে শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের খুচরা মূল্য ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল।

রূপালী চৌধুরী বলেন, '২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। বাড়তি খরচ কমাতে অনেক কোম্পানি পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু, ভালো মুনাফা নিশ্চিত করতে এই মূল্য সমন্বয় যথেষ্ট ছিল না।'

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফার মার্জিন (বিক্রির তুলনায় মুনাফার হার) আগের বছরের ১০ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

যদিও গত অর্থবছরে বিক্রয়ে প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। কিন্তু, এটি উচ্চ মূল্যের কারণে হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে বিক্রির প্রবৃদ্ধি কম ছিল বলে জানান তিনি।

২০২২-২৩ অর্থবছরে সব কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ১ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। এর পরে আছে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন, ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ৪৫২ কোটি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ৪৪২ কোটি টাকা এবং পদ্মা অয়েল ৩৪৯ কোটি টাকা।

বিক্রির দিক থেকে কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে এসিআই লিমিটেড, যার লেনদেন দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এর পরে আছে ক্রমান্বয়ে বিএসআরএম লিমিটেড ১১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, বিএসআরএম স্টিল ৮ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, বেক্সিমকো লিমিটেড ৬ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা, ওয়ালটন ৬ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা এবং জিপিএইচ ইস্পাত ৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মাকসন্স স্পিনিং মিলসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'গত অর্থবছরে কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।'

'গ্যাস সংকটের মধ্যে অনেক টেক্সটাইল মিল মালিককে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমাতে হয়েছে। একইভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে তাদের আমদানির সীমা কার্যত কমে যাওয়ায়।'

উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, ডলারের দাম ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় ওঠার কারণে আমদানিকারকের এলসি খোলার সীমা ১ ডলার থেকে কমে ০.৮৩ ডলার হয়ে গেছে।

এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মূল্যস্ফীতির চাপে পশ্চিমা বাজারেও বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়ে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমান ব্যবসা পরিস্থিতি নিয়ে মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো, তবে প্রাক-সংকট পর্যায়ে ফিরে আসেনি।'

বিভিন্ন খাতের মধ্যে তেল সরবরাহকারী সরকারি কোম্পানিগুলোর মুনাফা মার্জিন সবচেয়ে বেশি। তাদের অনেক টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে। যেখান থেকে তাদের সুদ আয় বেড়েছে। ফলে তাদের মুনাফা মার্জিন হয়েছে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ।

বিক্রি থেকে মুনাফা করার সক্ষমতার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে হোটেল। এই খাতের মুনাফা মার্জিন হয়েছে ২৭ শতাংশ।

হোটেল ব্যবসা ভালো করার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বেস্ট হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ। বেস্ট হোল্ডিংস হলো লা মেরিডিয়ান হোটেলের মালিক। তিনি বলেন, 'আমাদের কাঁচামালের জন্য ন্যূনতম খরচ লাগে। সুতরাং, লাভের মার্জিন বেশি। এখানে ব্যয়ের একটি বড় খাত শ্রম ব্যয়।'

খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, টেলিকম ও আইটি খাতে মুনাফার মার্জিন ছিল যথাক্রমে ১৫ শতাংশ, ১৪ শতাংশ ও ১১ শতাংশ। ওষুধ ও বিদ্যুৎ খাতে মুনাফা মার্জিন হয়েছে যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বস্ত্র ও চামড়া খাতের মুনাফা মার্জিন ছিল ৩ শতাংশের কম।

খাদ্য খাতের মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশ। কিন্তু, হেভিওয়েট ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ার বাদ দিলে এ খাতের মুনাফা মার্জিন ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে আসবে।

এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইমাম করপোরেট খাতের মুনাফা কমার পেছনে উচ্চ পরিবহন খরচ ও সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়াকে জন্য দায়ী করেছেন।

'এছাড়া বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যবসা ঋণের ওপর নির্ভরশীল, তাই উচ্চ সুদের হার তাদের ব্যয় বাড়িয়েছে,' বলেন তিনি।

তিনি বলেন, করপোরেট সুশাসন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে ব্যবসায়ীরা এই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মোকাবিলার ভালো কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না।

তিনি আরও বলেন, 'বেশিরভাগ কোম্পানি পণ্যের দাম বাড়ালেও কাঁচামাল ও উৎপাদন ব্যয় বেশি হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মুনাফা কমে গেছে।'

আলী ইমাম মনে করেন- সুশাসন, বিশ্বস্ত গ্রাহক, মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা, কম ঋণ এবং উদ্বৃত্ত নগদ রয়েছে যেসব কোম্পানিতে আগামী মাসগুলোতে তারা ভালো ব্যবসা করবে। অন্যরা ভালো করবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।

(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন রবিউল কমল)

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

2h ago