বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি: ব্যবসায়ীদের ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’

ভর্তুকি কমাতে সরকার গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭০ পয়সা বাড়িয়েছে।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি
খুলনার জিরো পয়েন্ট এলাকায় গাড়ি মেরামত করছেন এক শ্রমিক। বিদ্যুতের দাম আবারও বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

জ্বালানি ও কাঁচামালের বেশি দাম এবং টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়নের কারণে গত দুই বছর ধরে ব্যবসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় আবারও উৎপাদন খরচ বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

ভর্তুকি কমাতে সরকার গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭০ পয়সা বাড়িয়েছে।

এর আগে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ পয়সা বাড়িয়ে দেয় সরকার।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি শিল্প খাতের জন্য নতুন কিছু নয়।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুতের দাম তিনবারে প্রায় পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। একইভাবে ডিজেলের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ ও ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়েছে ৪১ দশমিক চার শতাংশ।

একই অর্থবছরে শিল্প-কারখানার জন্য গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৭৮ শতাংশ করা হয়।

এ ছাড়াও, গত কয়েক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ২৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় কাঁচামালের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ। দেশে ডলার কম আসায় এবং পণ্য আমদানিতে বেশি ডলার খরচ হওয়ায় রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। এ থেকে মুক্তির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

'উৎপাদন খরচ বেশি ও বিদ্যমান পরিবেশের কারণে ব্যবসায়ীরা এমনিতেই বিপাকে আছেন' উল্লেখ করে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যুতের বাড়তি দাম ব্যবসায়ীদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো।'

জ্বালানির দাম বাড়লেও উদ্যোক্তারা এসবের সরবরাহ ঠিকমতো পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এর পাশাপাশি শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য বড় বড় সমস্যায় আছে।

অর্থাৎ, সংকট থাকায় এলসির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে গত বছরের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদের ঊর্ধ্বসীমা নয় শতাংশ থেকে সরে আসার পর ব্যাংকগুলো ঋণের ওপর সুদের হার বাড়িয়েছে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ঋণের খরচ চার শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। এটি ব্যবসা ও শিল্পের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হয়েছে।

মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, 'এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানির বেশি দাম পণ্যের খরচ বাড়াবে ও রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমবে। রপ্তানি আয় কমে গেলে অর্থনীতি চাপ পড়বে।'

গত জুনে শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় ধাক্কা লেগেছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১৫৮ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ৯৯ প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমেছে। এ জন্য জ্বালানির বাড়তি খরচ, কাঁচামালের বেশি দাম ও টাকার অবমূল্যায়নকে দায়ী করা হয়েছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিল্প খাত পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছে না। তারপরও সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে।'

তার প্রশ্ন—'পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে না পারলে দাম বাড়াচ্ছেন কেন?'

'বিনিয়োগের পরিবেশ দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের ওপর নির্ভরশীল রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) স্কিমের সুদ বাড়িয়ে দেওয়ায় ইডিএফ ঋণ ব্যয়বহুল হয়েছে।

১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইডিএফ স্কিম দেশের উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য কেনায় সহায়তা করে।

মোহাম্মদ আলী খোকন আরও বলেন, 'রপ্তানিকারকদের কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজনে ডলার কিনলে এর দাম বেশি হয়। আবার পরে তারা ডলার ভাঙালে এর দাম কম হয়।'

ব্যাংকগুলো রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে প্রতি ডলার কিনে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় এবং তা আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করে ১১১ টাকায়।

'এমন অবস্থায় শিল্প-কারখানা বাঁচবে কী করে?'

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত মেনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানির দাম নির্ধারণ ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। ভর্তুকি কমাতে ও অল্প আয়ের মানুষদের সহায়তায় আইএমএফ এমন পরামর্শ দিয়েছে।

অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়লে স্থানীয় বাজারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বাড়বে, কমলে এখানেও তা কমবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরীর প্রশ্ন—'আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলে দেশে কমবে তো?'

তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। বিশ্ববাজারে দাম কমার পরপরই দেশে দাম কমে না।'

'স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালানির স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় করতে পারে কিনা তা দেখার বিষয়।

শিল্প-কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে পণ্যের চাহিদা কমেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এমনটি দেখা গেছে। এটি গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

গত বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি ছিল।

তার ভাষ্য, 'মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকায় মানুষ খাবারের বাইরে অন্যান্য পণ্য কম কিনছেন। জীবনযাত্রার খরচ আরও বাড়লে খুচরা বিক্রি কমে যাবে।'

তিনি আরও বলেন, 'মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ ও ঋণকে ব্যয়বহুল করেছে। ব্যাংকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ঋণ না দিয়ে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করছে। এ অবস্থায় অনেক প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা কষ্টকর হবে।'

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় ও খরচ বাড়ছে বলে ভর্তুকি কমানো ছাড়া সরকারের বিকল্প নেই।

তারা ব্যবসা ও শিল্প-কারখানার উত্পাদন ও প্রতিযোগিতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এটি পণ্যের দাম ও মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'জ্বালানির দাম বাড়ানোর পেছনে সরকারের যুক্তি হচ্ছে ভর্তুকি অনেক বেড়েছে। কম রাজস্ব আদায় হওয়ায় উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। সরকারের কিছু ভুল নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুৎ খাতে প্রচুর ভর্তুকির প্রয়োজন হচ্ছে।'

দীর্ঘদিন ধরে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখার অনুমতি দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামগ্রিক খরচ বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, ধীরে ধীরে দাম সমন্বয় করা উচিত যাতে মানুষের খুব কষ্ট না হয়।

এম কে মুজেরি আরও বলেন, 'দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারকে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতির জন্য জনগণ ভুগছে।'

তিনি সরকারকে সঠিক নীতি নেওয়া ও দুর্নীতি কমানোর আহ্বান জানান।

Comments