কর আদায় বাড়ছে, তবুও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে এনবিআর

অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাস যদি সত্যি হয়, তাহলে টানা ১২ বছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হবে এনবিআর।
এনবিআর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফ,

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে কর আদায়ে প্রায় ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবুও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে সরকারের ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হতে পারে। কারণ এ অর্থবছর আগামী ৩০ জুন শেষ হবে।

দুটি গবেষণা সংস্থাও একই কথা বলেছে। তারা বলছে, বছরের শুরুতে সরকারের এই লক্ষ্যমাত্রাকে অনেক অর্থনীতিবিদ উচ্চাভিলাষী বলেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই লক্ষ্যমাত্রা হয়তো অর্জিত হবে না।

আর অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাস যদি সত্যি হয়, তাহলে টানা ১২ বছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হবে এনবিআর।

এনবিআরের সাময়িক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করা হয়েছে, যা অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ।

অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চলতি অর্থবছরের বাকি সময়ে আরও ১ লাখ ২০ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আপাতত মনে হচ্ছে অর্থবছরের শেষ নাগাদ বড় ধরনের ঘাটতি থাকবে।'

তিনি জানান, অর্থবছরের শেষ দিকে রাজস্বের একটি বড় অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হলেও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ও প্রকৃত আদায়ের মধ্যে বড় অঙ্কের ব্যবধান থাকতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক বলেন, 'এবারও কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।'

'অর্থনীতিতে মন্দা পরিস্থিতি চলছে ও সরকার আমদানি বিধিনিষেধ আরোপ করায় এনবিআরের পক্ষে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে,' মন্তব্য করেন তিনি।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের মধ্যে ডলার সাশ্রয়ে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় আমদানি কমেছে। ফলে অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে কর আদায় আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়ে ৮২ হাজার ৫২২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া আয়কর ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৯৩ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা হয়েছে। অন্যদিকে রাজস্বের সবচেয়ে বড় উৎস মূল্য সংযোজন কর আদায় ১৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শনিবার বলেন, 'এখনো অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে যারা পণ্য বিক্রি থেকে আদায় করা ভ্যাট জমা দেয় না।'

দেশের ৮৫ শতাংশের বেশি রাজস্ব আদায় করে এনবিআর। তাই এনবিআর যদি লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশের রাজস্ব পরিসর আরও সংকুচিত হবে এবং ভবিষ্যতে আরও সমস্যার মুখে পড়তে হবে।

এ বিষয়ে পিআরআইয়ের এম এ রাজ্জাক বলেন, 'কারণ সরকার উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় করতে পারবে না এবং দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারবে না। অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের জন্য যদি আবার ঋণের প্রয়োজন হয়, তাহলে দেশ দুষ্টচক্রে পড়তে পারে।'

এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ছিল আনুমানিক ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

তবে বাংলাদেশের আরও কর আয় বাড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে।

পিআরআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করজাল সম্প্রসারণ ও ব্যক্তিগত আয়ের ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্সের মাধ্যমে কর আদায় দুই শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়াতে পারলে বাংলাদেশ অতিরিক্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকা পাবে। এতে কর-জিডিপি অনুপাত বেড়ে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে।

পিআরআই বলছে, সরকার যদি অতিরিক্ত রাজস্ব বিনিয়োগ করে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে।

সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকারের ব্যয় পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

তিনি পরামর্শ দেন, এনবিআরের ডিজিটালাইজেশনের জন্য বিনিয়োগ আবশ্যক এবং যথাযথ সমন্বয় থাকতে হবে। কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকেও নজর দিতে হবে।

তিনি প্রত্যক্ষ করকে অগ্রাধিকার দিতে এবং আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় করতে এনবিআরের প্রতি আহ্বান জানান। এতে কর ফাঁকি কমানো সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, কর ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশনের কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। একটি দেশ ছয় মাস থেকে নয় মাসের মধ্যে কেন এটি কার্যকর করতে পারে না তা আমার বোধগম্য নয়।

ভ্যাট ও শুল্কের ওপর গুরুত্বারোপ প্রাচীন ধারণা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এ থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে।'

তিনি বলেন, 'ভারত গত পাঁচ বছরে কর-জিডিপি অনুপাত ১২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৮ শতাংশ করেছে। তাই চাইলে এই অনুপাত বাড়ানো সম্ভব।'

'কর দাখিল না করা এবং কর ফাঁকির জন্য কঠোর জরিমানা কঠোর হওয়া উচিত। ধনী ও বিত্তবানদের ট্যাক্স ফাইল নিরীক্ষা করা উচিত,' বলেন তিনি।

এদিকে সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের জন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি এবং গত পাঁচ বছরে গড় বার্ষিক রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ১১ শতাংশের বেশি।

Comments