ক্যানসার চিকিৎসায় আশা জাগাচ্ছে দেশে উৎপাদিত ওষুধ

দেশের প্রায় ১৭ প্রতিষ্ঠান ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধ তৈরি করায় স্থানীয় রোগীরা এখন তা কম দামে পাচ্ছেন। এতে চিকিৎসা খরচ কমছে।
ক্যানসারের ওষুধ
দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯০ শতাংশ মেটাচ্ছে। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

গত ১৪ বছরে দেশের ওষুধ খাত অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু যে দেশের ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধের চাহিদার ৯০ শতাংশই মেটাচ্ছে তা নয়। প্রায় ১৫০ দেশে রপ্তানি করে তারা শত শত কোটি ডলার আয়ও করছে।

এই খাতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মধ্যে আছে ক্যানসারের ওষুধ তৈরিতে তাদের অগ্রগতি।

গত ১৪ বছরে বীকন, এসকেএফ, রেনাটা, ইনসেপ্টা, হেলথকেয়ার ও টেকনো ফার্মার মতো ওষুধ তৈরির দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ১১০টিরও বেশি ধরনের ক্যানসারের ওষুধ তৈরি করছে।

দেশের প্রায় ১৭ প্রতিষ্ঠান ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধ তৈরি করায় স্থানীয় রোগীরা এখন তা কম দামে পাচ্ছেন। এতে চিকিৎসা খরচ কমছে।

বীকন মেডিকেয়ারের প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ওষুধের দাম অনেক রোগীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।'

তিনি আরও বলেন, 'সারাবিশ্বে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ঘাটতি আছে। যখন ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধ তৈরি শুরু হয়েছিল তখন দাম অনেক বেশি থাকায় সাধারণ মানুষ তা কিনতে পারতেন না। বিষয়টিকে মাথায় রেখে আমাদের প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ওষুধ তৈরি শুরু করে। যাতে করে বিশ্বব্যাপী রোগীরা কম খরচে ক্যানসারের ওষুধ কিনতে পারেন।'

ক্যানসারের ওষুধ
দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধ তৈরি করায় স্থানীয় রোগীরা তা কম দামে পাচ্ছেন। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

২০০৯ সালের আগে অত্যাধুনিক ক্যানসারের ওষুধ তৈরির বিষয়ে বীকন সংশয়ে ছিল। যা হোক, এখন তারা সফল হয়েছে। রোগীরা এখন ন্যায্য দামে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ কিনতে পারছেন।

বীকন দেশে ক্যানসারের ওষুধ উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে দাবি করে তিনি বলেন, 'এটি এখন ক্যানসারের ওষুধের স্থানীয় চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করছে।'

২০১০ সালের আগে ক্যানসারের ওষুধ পুরোটাই আমদানি করতে হতো। ওষুধের অত্যধিক দামের কারণে শুধুমাত্র আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের রোগীরাই ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে পারতেন। আজ এটি কেবল দেশের চাহিদাই পূরণ করছে না, রপ্তানিও করছে।

মঞ্জুরুল আলম মনে করেন, দেশের ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ঠা ও দেশীয় পণ্যের প্রতি চিকিৎসক ও রোগীদের আস্থার কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, পৃথিবীতে যত ধরনের ক্যানসারের ওষুধ আছে তার প্রায় ৯৯ শতাংশ স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। তবুও কিছু রোগী এখনো আমদানি করা ওষুধ বা অন্যভাবে পাওয়া বিদেশি ওষুধের ওপর ভরসা করেন।

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় ও ডলার সংকটের কারণে ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার ও ওষুধ প্রস্তুতকারকদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

কম আয়ের রোগীদের বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।

ক্যানসারের ওষুধ
প্রতি বছর দেশে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এর বিক্রি এক হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

বিশ্বব্যাপী ক্যানসারের ওষুধের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বীকন দ্বিতীয় কারখানার পরিকল্পনা করেছে। রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে তারা প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেন্টার স্থাপনের কথাও ভাবছে।

এই খাতে অপেক্ষাকৃত নতুন 'এসকেএফ অনকোলজি'। ২০১৮ সালে এর যাত্রা শুরু। তবে প্রতিষ্ঠানটির হাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকায় তারা অল্প সময়েই দেশের বাইরেও তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করেছে।

ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধ উৎপাদনের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (ইইউ জিএমপি) থেকে অনুমোদন পাওয়া কয়েকটি এশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসকেএফ অনকোলজি অন্যতম। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি বিশ্ববাজারে প্রবেশের 'পাসপোর্ট' হিসেবে বিবেচিত হয়।

এসকেএফের নির্বাহী পরিচালক (বিপণন ও বিক্রয়) মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই স্বীকৃতির ফলে ইইউ ও অন্যান্য দেশে আমাদের ওষুধ রপ্তানি সহজ হয়েছে।'

এসকেএফ বর্তমানে ৬০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে।

মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম আরও বলেন, 'আধুনিক প্রযুক্তি, সুযোগ-সুবিধা ও অবিচল নিষ্ঠার কারণে এসকেএফ অনকোলজি দেশে-বিদেশে রোগীদের কাছে কম দামে বিশ্বমানের ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধ সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্যানসার চিকিৎসা ও ওষুধ উৎপাদনে দেশ অসাধারণ উন্নতি অর্জন করেছে।'

ক্যানসারের ওষুধ
২০১০ সালের আগে ক্যানসারের ওষুধ পুরোটাই আমদানি করতে হতো। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

২০২৩ সালে বাংলাদেশ এক হাজার কোটি টাকার ক্যানসারের ওষুধ রপ্তানি করেছে। ২০১৯ সালে তা ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বলছে, প্রতি বছর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে ক্যানসার-প্রতিরোধী ওষুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ক্যানসারের ওষুধ বিক্রির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম আবদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে বিশ্বমানের কারখানা করেছে।'

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে তৈরি ক্যানসারের ওষুধ বিশ্ববাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে। সেগুলো বিশ্বমানের পাশাপাশি কম দামের হবে।

তবে উদ্বেগের কারণও আছে।

আগামী ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসবে তখন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্যানসারের ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পেটেন্ট গাইডলাইন মনে চলতে হবে। সেসময় দেশে ওষুধের দাম বাড়বে।

এমন পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (ট্রিপস) ছাড়ের মেয়াদ ছয় থেকে নয় বছর ও পরে ২০৩৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে ২০২২ সালের জুনে জেনেভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসতে যাওয়া দেশগুলোর জন্য সময়সীমা বাড়াননি।

বর্তমান চুক্তি অনুসারে, স্বল্পোন্নত দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারকরা ২০৩৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত পেটেন্ট নীতিমালা অনুসরণ না করেই যেকোনো জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে। কিন্তু, বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসতে যাচ্ছে তাদের জন্য এ সুবিধা প্রযোজ্য নয়।

বীকন মেডিকেয়ারের প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল আলম বলছিলেন, এটি কেবল নতুন মলিকিউলসের জন্য প্রযোজ্য হবে। এর মধ্যে কয়েকটি ওষুধ আছে। তাই উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার পর বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদন খাত বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে না।

Comments