সাপ্তাহিক পর্যালোচনা

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর বিনিয়োগে কতটা পরিবর্তন আসবে?

গত ছয় বছরে চীনা বিনিয়োগের উত্থান-পতন দেখেছে বাংলাদেশ। এমনকি অতীতে বিনিয়োগের যে উত্থান দেখা গিয়েছিল, গত কয়েক বছরে তার কাছাকাছি আর যেতে পারেনি চীনা বিনিয়োগ।
চীনা বিনিয়োগ, এফডিআই, শেখ হাসিনা,

বাংলাদেশ আশা করেছিল, করোনা মহামারির পর দেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ চীনের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের জন্য একটি ভালো বিকল্পের সন্ধানে ছিলেন। যেখানে তারা ব্যবসা করতে পারবেন।

কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং গত ছয় বছরে চীনা বিনিয়োগের উত্থান-পতন দেখেছে বাংলাদেশ। এমনকি অতীতে বিনিয়োগের যে উত্থান দেখা গিয়েছিল, গত কয়েক বছরে তার কাছাকাছি আর যেতে পারেনি চীনা বিনিয়োগ।

২০১৮ সালে চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে তা কমে ৬২৬ মিলিয়নে নেমে যায়। মহামারির সময় অর্থাৎ ২০২০ সালে তা আরও কমে মাত্র ৯১ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। অবশ্য ২০২১ সালে চীন থেকে ৪০৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আসে। তখন ধারণা করা হয়েছিল, পরবর্তী বছরগুলোতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। কিন্তু ২০২২ সালে চীনা বিনিয়োগ কমে ১৮৭ মিলিয়ন হয় এবং ২০২৩ সালে আবার কিছুটা বেড়ে ২৬০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।

বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চলকে (সিইআইজেড) প্রায়ই একটি উপায় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) উদ্যোগ নেওয়ার আট বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের নির্মাণ কাজ এখনো শুরু হয়নি।

এছাড়া বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের জন্য ইতোমধ্যে একটি যৌথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। কিন্তু কবে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এমন হতাশাজনক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আশাবাদী ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বেইজিং সফর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও চীন থেকে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।

সফরকালে বাংলাদেশি ও চীনা কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে ১৬টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে চারটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশ ৪৯০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পাবে।

আশা করা হচ্ছে- চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের টেক্সটাইল, বৈদ্যুতিক গাড়ি, সৌরশক্তি, ফিনটেক ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করবে।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, চীনা বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকও বাংলাদেশের বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

তিনি বলেন, বিনিয়োগ প্রস্তাব ও সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হলে চীন থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এফডিআই আসবে।

নিহাদ কবির বলেছেন, 'এই বিনিয়োগগুলো বাস্তবায়িত হতে সময় লাগবে।' কিন্তু তিনি সমঝোতা স্মারকগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরেন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, 'একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে।'

তার ভাষ্য, দুই দেশের মধ্যে বেসরকারি খাতের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবাহ সরকার-টু-সরকার লেনদেনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বেশি।

'এই সফরটি মূলত দুই দেশের বেসরকারি খাতের সহযোগিতা বাড়ানোতে গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এই অঞ্চলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে চীনের সঙ্গে বড় বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ। তবে এই ভারসাম্য রক্ষায় শেষ পর্যন্ত চীনে রপ্তানি বাড়াতে হবে।

আশরাফ আহমেদ বলেন, এ লক্ষ্যে বাংলাদেশকে চীনের ক্রমবর্ধমান বাজারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, চীনের বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।

'প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরকালে প্রায় এক হাজার চীনা বিনিয়োগকারী ও শিক্ষাবিদ একটি বাণিজ্য সম্মেলনে অংশ নেন,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যৌথ উদ্যোগে হোক বা না হোক, চীনা বিনিয়োগে বাংলাদেশ লাভবান হবে। পাশাপাশি, চীনা ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হবেন, কারণ তাদের পণ্যগুলো চীনে তৈরি পণ্যের চেয়ে কম শুল্কে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করবে।

তবে বাংলাদেশ কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল হলেও চীনের কাঁচামাল থেকে শুরু করে প্রযুক্তি ও মূলধন সবই তাদের দখলে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন সিদ্দিকুর রহমান।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (আগের টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশকে সুদমুক্ত ঋণসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ ও চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করবে। এ উপলক্ষে চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করতে আগ্রহী।

তিনি জানান, চীন বাংলাদেশ থেকে পাট ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, আমসহ অন্যান্য ফল এবং সিরামিক আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্য, কারিগরি, কৃষি ও উৎপাদন খাতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিপরীতে দেশটি থেকে ২২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে।

Comments