এডিপি ব্যয় ৪৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। সদ্য সমাপ্ত এই অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ৬৮ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে, যা ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের পর থেকে সবচেয়ে কম অগ্রগতি।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, সংশোধিত বরাদ্দের ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকার মধ্যে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলো মাত্র ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও এর পর শেখ হাসিনা সরকারের পতন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির মতো নানা কারণে বাস্তবায়নের গতি ধীর হয়ে পড়ায় চলতি বছরের মার্চে সরকার মূল এডিপি বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা থেকে ১৮ শতাংশ কমিয়ে দেয়।
সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন যা ব্যয়ের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় তা মূল বরাদ্দের মাত্র ৫৫ শতাংশ ছিল।
কর্মকর্তারা এই বড় ঘাটতির কারণ হিসেবে ব্যাপক জন-অসন্তোষ, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর প্রকল্পগুলোর ওপর কঠোর নজরদারি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলার লক্ষ্যে ব্যয় কমানোর পদক্ষেপকেও দায়ী করেছেন।
তবে বাস্তবায়নের চূড়ান্ত হার অর্থনীতিবিদদের অবাক করেছে।
'নিঃসন্দেহে এটি হতাশাজনক,' বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। 'অর্থবছরের প্রথমার্ধে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যা বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করেছে।'
তিনি উল্লেখ করেন, 'কম উন্নয়ন ব্যয় শুধু সরকারি খাতেই নয়, বেসরকারি খাতেও প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।'
এর আগে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নের হার রেকর্ড করা হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে, যখন কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হয়েছিল। সে সময় বাস্তবায়নের হার ছিল ৮০ শতাংশ।
আইএমইডি জানিয়েছে, সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ সর্বনিম্ন ১৫.৩৬ শতাংশ ব্যয় করেছে। এরপরই রয়েছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, যারা তাদের বরাদ্দকৃত তহবিলের ২২ শতাংশ ব্যয় করেছে।
এর ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা গেছে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ বিভাগে।
এই দুই বিভাগ—বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ—সংশোধিত বরাদ্দের ৯৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করে শীর্ষ পারফরমার হিসেবে উঠে এসেছে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যয় কমাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করেছে, যার ফলে কিছু খাতে বাস্তবায়নের হার কমে গেছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, 'এরপরও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়া জনসেবার জন্য হতাশাজনক।'
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে এডিপি বাস্তবায়নের ধীরগতির পেছনে মূল কারণ ছিল প্রশাসনিক বিলম্ব, প্রকল্প যাচাইয়ের ঘাটতি এবং রাজস্ব আদায়ে কমতি।
তিনি বলেন, 'জুলাই ও আগস্টে কার্যত কোনো কাজই করা সম্ভব হয়নি।' এই ধীরগতির জন্য তিনি নতুন প্রশাসনের পুনর্গঠন এবং মৌলিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে সময় নেওয়াকে দায়ী করেন। 'প্রাত্যহিক কাজ চালিয়েই টিকে থাকা ছিল প্রথম ছয় মাসে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকার মেগা প্রকল্পে গতি কমানোর এবং ছোট রাজনৈতিক প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল— কিন্তু এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটাই বাস্তবায়নে দেরি করিয়েছে।'
রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকার ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনাও কমিয়ে দিয়েছে।
বিভিন্ন বিভাগের ব্যয় হারের তীব্র পার্থক্যের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, "এই বৈষম্য আরও গভীর কাঠামোগত ও প্রশাসনিক অদক্ষতার দিকে ইঙ্গিত করে।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, 'বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিনের ক্রয় ব্যবস্থাপনার জটিলতা ও আমলাতান্ত্রিক সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে, যার ফলে এসব খাতে বাস্তবায়ন বরাবরই দুর্বল রয়ে গেছে।'
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী অস্থির সময়কাল ছিল এডিপি বাস্তবায়নের নিম্নহারের অন্যতম প্রধান কারণ।
তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে প্রশাসনিক পুনর্গঠনে বিলম্ব হয়েছে। অতীতের দুর্নীতির অভিযোগ এড়াতে রাজনৈতিক সতর্কতাও বাস্তবায়নের গতি আরও কমিয়ে দেয়।'
সেলিম রায়হান আরও বলেন, 'বিতর্কে জড়ানোর ভয়ে আমলারা পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকল্পগুলো নিয়ে এগিয়ে যেতে অনীহা দেখিয়েছেন। একটি স্পষ্ট ম্যান্ডেট বা দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগের অভাব ছিল।'
সেলিম রায়হান চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে মূল খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, "স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রকল্পগুলোকে এগিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল। অথচ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বরাদ্দের মাত্র ২১ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে – এটি উদ্বেগজনক।'
তিনি বাস্তবায়ন সক্ষমতার ঘাটতির দিকেও ইঙ্গিত করেন। রায়হান বলেন,'সরকার পরিবর্তনের পর অনেক রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ঠিকাদার নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল, এবং তাদের বিকল্প খুঁজে বের করার মতো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা সরকারের ছিল না। আমলাতন্ত্রও পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত ছিল না।'
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব কামাল উদ্দিন এডিপি বাস্তবায়নের হার নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি জানান, সম্প্রতি তিনি এই বিভাগে দায়িত্ব নিয়েছেন, তাই এ বিষয়ে তার স্পষ্ট ধারণা নেই।
Comments