সুখবর নেই চাকরির বাজারে

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, তার মূল চালিকা শক্তি ছিল কর্মসংস্থানের দাবিতে হওয়া আন্দোলন। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও চাকরির সুযোগ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি।
সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তির পরিমাণ খুবই সামান্য হওয়ায় আগের মতোই চরম প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে হাজারো স্নাতক ডিগ্রীধারীকে।
গত এক বছরে ব্যাংক ঋণ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির তথ্য অনুযায়ী, নতুন ইউনিট চালু করা তো দূরে থাক, অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন সচল রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। যার ফলে, কারখানার মূল ফটকে চাকরির বিজ্ঞপ্তিও কমেছে।
সেইসঙ্গে, কাজের জন্য বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যাও আগের বছরের তুলনায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ কমেছে।
সীমিত অর্থায়নের কারণে আগে থেকেই চাপে রয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। তার সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের ব্যয় বেড়েছে, বিক্রিও কমছে।
২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মূলত দুর্বল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। দুই অঙ্কের ঘরে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আর্থিক নীতিতে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এমন নীতির ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ পাওয়া আরও ব্যয়বহুল হয়ে যায় এবং প্রভাব ফেলে বিনিয়োগে। ফলস্বরূপ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থান তৈরিতেও।
এ ছাড়া, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক মাসে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেও অনেক উদ্যোক্তা তাদের বিনিয়োগ বাড়াননি।
গত কয়েক মাস ধরে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখাই সরকারের মূল মনোযোগের বিষয়। যার কারণে, কমেছে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ।
পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনতে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে দক্ষতার ঘাটতি কমাতে সরকারি উদ্যোগ জরুরি থাকলেও এমন পরিকল্পনা দৃশ্যমান হয়নি।
কেবলমাত্র ইতিবাচক অগ্রগতি এতটুকুই যে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ে একটি নতুন কর্মসংস্থান শাখা খোলা হবে।
দেশে অধিকাংশ চাকরির সুযোগ তৈরিকারী বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের মন্দাভাবের সময়টায় এসে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন।
গত এক দশকে কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, শিল্পখাতে শ্রমিকের সংখ্যা ২০১৩ সালের ১ কোটি ২১ লাখ ছিল। ২০২৪ সালে তা কমে ১ কোটি ২০ লাখে দাঁড়িয়েছে।
শিল্পখাতে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোট কর্মসংস্থানও কমেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মোট কর্মসংস্থান ছিল সাত কোটি নয় লাখ, যা ২০২৪ সালে প্রায় তিন শতাংশ কমে হয়েছে ছয় কোটি ৯১ লাখ।
দেশে বেকারত্ব কমাতে বড় আকারে ভূমিকা রাখে প্রবাসে কর্মসংস্থান। ২০২৪ সালে এই হার ২২ শতাংশ কমে ১০ লাখে দাঁড়িয়েছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের মে মাস পর্যন্ত চার লাখের বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করতে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'কর্মসংস্থান নিয়ে তরুণরা ভীষণ উদ্বিগ্ন।'
তিনি সানেমের সাম্প্রতিক এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, পরিস্থিতির বদল হয়নি। এমনকি গত এক বছরে ৫০ শতাংশেরও বেশি চাকরিপ্রার্থী সাক্ষাৎকারের জন্যও ডাক পাননি।
অধ্যাপক সেলিম বলেন, 'সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বেসরকারি খাতের স্থবিরতা। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের পরিসর বাড়াচ্ছে না। তারা এমন যে অবস্থায় আছে, সেটুকুই কেবল চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি কঠিন হয়ে গেছে।'
বেসরকারি বিনিয়োগ কমার চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধিতেও। বর্তমানে এই হার কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে।
অধ্যাপক সেলিমের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসলে ফেরেনি। নিয়মিতভাবে সহিংসতার ঘটনা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের ব্যর্থতায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'কর্মসংস্থানই ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি কেন্দ্রীয় ইস্যু। অথচ, এই ক্ষেত্রেই সরকার কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি। গত এক বছরে তাদের কোনো উদ্যোগই বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে পারেনি।'
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'দক্ষতার অসামঞ্জস্যও একটি বড় সমস্যা। শিক্ষার্থীরা যা শেখে এবং শ্রমবাজারের যে চাহিদা, তার মাঝে বিস্তর ফারাক। গত এক বছরে শিক্ষাখাত সংস্কারের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার বিশ্বাস, এটা অনেক বড় একটা সুযোগ ছিল, কিন্তু আমরা সেটা হারালাম। গত এক বছরে যদি এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হতো, তাহলে পরবর্তী সরকারও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চাপে থাকতো।'
সরকার আগামী তিন বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ খাতে ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ ছাড়া কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই) খাতে তিন হাজার নারীকে সংযুক্ত করে মোট ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বেকারত্ব মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্য যুবঋণের সীমা দুই লাখ টাকা এবং সফল উদ্যোক্তাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি যুবকদের জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিল বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সরকার ২০২৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নয় লাখ তরুণকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দেওয়ারও পরিকল্পনা করছে। ইতোমধ্যে ৪৮টি জেলায় ২৮ হাজার ৮০০ শিক্ষিত বেকারের জন্য ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।
গত মে মাসে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। জাপানি কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা আগামী পাঁচ বছরে অন্তত এক লাখ দক্ষ কর্মী বাংলাদেশ থেকে নিয়োগে তাদের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
শ্রম অধিকার ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিতে সংস্কার সুপারিশ দিতে সরকার সাইদ সুলতান উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।
কমিশন প্রধান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সেগুলো বাস্তবায়নের প্রস্তুতির জন্য একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর জন্য সময় লাগবে।'
তিনি বলেন, 'নিয়োগকর্তাদের চাহিদা ঠিকভাবে বোঝার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ে কর্মসংস্থান গবেষণার জন্য পৃথক বিভাগ থাকা জরুরি।'
তিনি সরকারি সংস্থা, দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, শিল্প সমিতি, একাডেমিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে আরও ভালো সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'এমন সহযোগিতা এখনো দেখা যাচ্ছে না।'
'যুবকদের জন্য চাকরি খুবই জরুরি। কিন্তু, কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি হয়নি,' যোগ করেন তিনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের নাম শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় হলেও এখানে কর্মসংস্থান শাখা নেই।
তিনি কর্মসংস্থান শাখা গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর কাজ চলছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তার মেয়াদকালে এই শাখা তৈরির কাজ সম্পন্ন নাও হতে পারে।
চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা বলেন, 'সেটা তো অবশ্যই দরকার। কিন্তু, এটা দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের অংশ। পরবর্তী সরকারকে এর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।'
Comments