প্রতি ৪ শেয়ারের ১টি বিক্রি হচ্ছে ফেস ভ্যালুর নিচে

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত প্রতি চারটি কোম্পানির মধ্যে একটির শেয়ার তার অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) ১০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে। যার মূল কারণ ওইসব কোম্পানিগুলোর দুর্বল পারফরম্যান্স।

এই তালিকার শীর্ষে আছে খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়াও, বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানো মিউচুয়াল ফান্ড এবং কিছু বস্ত্র খাতের কোম্পানির শেয়ারও এই তালিকায় রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, শেয়ারবাজারের এমন দুর্বল অবস্থা স্থানীয় ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীদের কাছেই আকর্ষণ হারাচ্ছে।

তাদের মতে, বাজারে শক্তিশালী কিছু কোম্পানি থাকলেও তা সংখ্যায় খুবই কম। তাই বিনিয়োগকারীরা এখন কেবল সেসব প্রতিষ্ঠানের দিকেই ঝুঁকছেন যাদের পারফরম্যান্স ভালো।

বিশ্লেষকরা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এই সংকট সমাধানে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে বন্ধ বা একীভূত করা এবং বাজারে নতুন ও শক্তিশালী কোম্পানি আনার পরামর্শ দিয়েছেন।

অভিহিত মূল্য হলো শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের নামমাত্র দাম, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থা নির্ধারণ করে দেয়। বাংলাদেশে প্রতিটি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ফেস ভ্যালু ১০ টাকা।

গতকাল ডিএসইতে ৩৯৭টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যার মধ্যে ৯৮টি শেয়ারের মূল্য ১০ টাকার নিচে ছিল। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি শেয়ারের দাম ৫ টাকার নিচে নেমে এসেছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কম দামের কোম্পানিগুলির মধ্যে ৩৩টি ব্যাংক বা এনবিএফআই, ৩৫টি মিউচুয়াল ফান্ড এবং ১৭টি টেক্সটাইল কারখানা। অনেক টেক্সটাইল কারখানা হয় উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে নয়তো দীর্ঘদিন ধরে লোকসান গুনছে। যদিও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাজার সূচক ঊর্ধ্বমুখী, কমদামের শেয়ারগুলো খুব একটা কমেনি।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, এই কম দামি শেয়ারগুলোর প্রায় অর্ধেককে 'জাঙ্ক' বা অকেজো হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কাজী মনিরুল ইসলাম বলেন, এত বিপুল সংখ্যক কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে যাওয়া মানে তাদের পারফরম্যান্স ভালো নয়। ফলে এসব শেয়ারের চাহিদা কম। এত বেশি সংখ্যক দুর্বল কোম্পানি থাকা মানেই বাজারে ভালো পারফরম্যান্স করা কোম্পানির সংখ্যা অনেক কম।'

এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানি প্রায় ৪০০টি হলেও বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগযোগ্য ধরা হয় মাত্র ৫০ থেকে ৬০টি কোম্পানি।

মনিরুল বলেন, 'সামগ্রিকভাবে এটি বাজারে ভালো শেয়ারের যে অভাব আছে সেটাই বোঝায়।'

কম দামি শেয়ারগুলোর মধ্যে ব্যাংক খাতের শেয়ার বিশেষভাবে চোখে পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ শেষে এই খাতে খেলাপি ঋণ পরিমাণ রেকর্ড ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা মোট ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। গত বছর সমস্যাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৫৬ লাখ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের ৪৫ শতাংশ।

তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ট) দেওয়া থেকে বিরত রাখতে হয়। বেশিরভাগ ব্যাংকের শেয়ারই এখন ফেস ভ্যালুর নিচে লেনদেন হচ্ছে।

মনিরুল ইসলাম বলেন, 'একসময় ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের প্রচুর চাহিদা ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেছে অনেক ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গেছে।'

তিনি বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো পুরো খাতকে নিচে নামিয়ে আনলেও, কিছু শক্তিশালী ব্যাংক আমানত আকর্ষণ করে এই মন্দার মধ্যেও ভালো পারফর্ম করেছে।

তিনি বলেন, 'এটি ভালো দিক যে বিনিয়োগকারীরা এখন বুঝতে পারছেন কোন ব্যাংক ভালো অবস্থায় আছে আর কোনটি নয়।'

কমদামের শেয়ারের বড় অংশ এনবিএফআই খাতের। অধিকাংশ নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠান অচল ঋণে জর্জরিত, অনেক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯টি এনবিএফআই বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্যে ৮টিই তালিকাভুক্ত। তবে তাদের শেয়ার লেনদেন এখনো চালু আছে। মনিরুল বলেন, 'তাই অধিকাংশ এনবিএফআইয়ের শেয়ার ধরে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।'

মিউচুয়াল ফান্ডগুলোও তাদের মূল্য হারিয়েছে, যার প্রধান কারণ অতীতে তাদের দুর্বল ব্যবস্থাপনা। সাধারণত, মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট মূল্য তার নিট সম্পদ মূল্যের কাছাকাছি থাকা উচিত। কিন্তু এখন বেশিরভাগই এই মূল্যের অর্ধেক দামে লেনদেন হচ্ছে। 'বিনিয়োগকারীরা মিউচুয়াল ফান্ডের আর্থিক বিবরণীকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই এখানে নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্ন থেকেই যায়,' বলেন তিনি।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'শেয়ারবাজারে এত জাঙ্ক শেয়ার রয়েছে যে তা বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চাই এবং ভালো শেয়ারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার দাবি জানাই, তখন এত বেশি সংখ্যক দুর্বল কোম্পানির উপস্থিতি মোটেও ইতিবাচক বার্তা দেয় না।'

তিনি সরকারকে বাজারে শক্তিশালী কোম্পানি আনার দিকে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসাথে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া বা একীভূত করার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়টি এনবিএফআই বন্ধ করার ঘোষণা দিলেও, সেগুলোর শেয়ার এখনও লেনদেন হচ্ছে। অন্তত এই শেয়ারগুলোর লেনদেন স্থগিত করা উচিত ছিল।'

ডিবিএ সভাপতি আরও বলেন, 'যদি কোনো কোম্পানির যথেষ্ট সম্পদ থাকে, তবে সেগুলোকে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের জন্য পাঠানো যেতে পারে।'

Comments