গুরু দত্ত: এক ট্র্যাজিক প্রতিভার আলো-অন্ধকারে ডুবে থাকা জীবন

গুরু দত্ত। ছবি: সংগৃহীত

গুরু দত্ত—এই নামটি কেবল একজন পরিচালক বা অভিনেতাকে বোঝায় না, বরং বোঝায় এক বেদনাময় কবিকে, যিনি রূপালি পর্দায় রঙের বদলে ছায়া আর আলো দিয়ে আঁকতেন নিজের হৃদয়ের ভেতরকার অশান্তি। মাত্র ৩৯ বছরের জীবন। কিন্তু এমন এক চলচ্চিত্র ভুবন রেখে গেছেন, যা আজও বিস্ময়ে, ব্যথায় আর ভালবাসায় নত করে দেয় মাথা।

শুরুটা: হেমন্তের দুপুরে জন্ম নেওয়া এক বিষণ্ণ কবি

১৯২৫ সালের ৯ জুলাই, কর্ণাটকের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া গুরু দত্তের শৈশব কেটেছে অনটনে। পরে কাজের সূত্রে পরিবার চলে যায় বাংলায়, আর সেখানেই তিনি জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিভূতিভূষণের লেখার সঙ্গে। এই বাংলা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে তার সিনেমার আত্মা।

শুরুতে তিনি ছিলেন কোরিওগ্রাফার, কখনো টেলিফোন অপারেটর। মুম্বাইয়ের আলো ঝলমলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশের আগে পদুকোন পদবি ঝেড়ে ফেলেন। তখনো কেউ জানতো না, এই মানুষটাই একদিন নির্মাণ করবেন 'পিয়াসা' আর 'কাগজ কে ফুল'—দুটি ছবি, যা হিন্দি সিনেমার 'আত্মা'র সংজ্ঞা বদলে দেবে।

বাজি থেকে পিয়াসা: গল্পের শুরু

বন্ধু দেব আনন্দের হাত ধরে প্রথম পরিচালনার সুযোগ পান ১৯৫১ সালে, ছবির নাম 'বাজি'। এক ধূসর শহর, এক জুয়া খেলা, আর তার মাঝে এক থ্রিল। কিন্তু এরপর তিনি ভালোবাসায় পড়েন গীতিকার ও গায়িকা গীতা রায়ের, এবং তার জীবন যেন কিছুটা সময়ের জন্য রঙিন হয়ে ওঠে।

'আর-পার' ও 'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ৫৫'—এই দুটি সিনেমা দিয়ে বক্স অফিসে সাফল্য পেলেও, তার শিল্পীসত্তা তৃপ্ত ছিল না। 'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ৫৫'-এ হাস্যরসের সঙ্গে তিনি দিয়েছিলেন সামাজিক চিন্তার খোরাক। কিন্তু তিনি খুঁজছিলেন এমন একটি ছবি, যেখানে তিনি নিজের যন্ত্রণা, অস্থিরতা, হতাশা—সব কিছু ঢেলে দিতে পারবেন।

মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ৫৫ সিনেমার দৃশ্যে গুরু দত্ত ও মধুবালা। ছবি: সিমোন অ্যান্ড শুস্টার

পিয়াসা: একটি আত্মার আর্তনাদ

পিয়াসা সেই ছবি, যা শুধু এক হতাশ কবির গল্প নয়, বরং এক সমাজের অমানবিকতা, শিল্পীর একাকিত্ব, ভালোবাসার মরীচিকা আর স্বপ্নভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস।

গুরু দত্তের বোন ললিতা লাজমি বলেছিলেন, 'এই ছবির জন্য দাদা তার ঘুম, তার স্বপ্ন, তার শান্তি সব কিছু হারিয়ে ফেলেছিলেন। মদ আর ঘুমের ওষুধে ভেসে যাচ্ছিলেন। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটির জন্য ১০৪টি শট নিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন নিখুঁত হতে, কিন্তু বিনিময়ে তিনি নিজেকেই নিঃশেষ করে ফেলছিলেন।'

১৯৫৬ সালে ছবির কাজ চলাকালীন আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরিবারের কেউ মানসিক চিকিৎসার কথা চিন্তাও করেননি—সমাজে তখনো মানসিক স্বাস্থ্য ছিল ট্যাবু। গুরু সেসময় থাকতেন পালি হিলে। কল্পনাকে বিভিন্ন সময় কথা বলার জন্য ডাকতেন ঠিকই, কিন্তু তার সামনে কোনো কথাই বলতে পারতেন না।

শেষ পর্যন্ত ১৯৫৭ সালে পিয়াসা মুক্তি পায়—সমালোচক আর দর্শক উভয়ের ভালোবাসায় ভাসে। কিন্তু গুরু দত্ত 'পিয়াসা'-র প্রধান চিত্রগ্রাহক ভি কে মূর্তিকে বলেছিলেন, 'আমি চেয়েছিলাম পরিচালক হতে, অভিনেতা হতে, ভালো ভালো সিনেমা বানাতে—আমি সব কিছুই অর্জন করেছি। আমার টাকা আছে, সবকিছু আছে...তবুও কিছুই নেই।'

কাগজ কে ফুল: নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি

এই সাফল্যের পরই তিনি ভুল করেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ভেঙে দেন—'একটি নিরীক্ষাধর্মী ছবির পর একটি বাণিজ্যিক ছবি'। বরং তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন তার জীবনের সবচেয়ে কাছাকাছি সেই চলচ্চিত্রে—কাগজ কে ফুল।

এই ছবিতে আছে একজন পরিচালকের একাকীত্ব, তার ভেঙে পড়া সংসার, তার মিউজের প্রতি জটিল টান, আর সেই শেষ পরিণতি—এক অন্ধকার, পরিত্যক্ত স্টুডিওর কোণে তার মৃত্যু। আজ ছবিটি ক্লাসিক, কিন্তু মুক্তির সময় একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিল। ব্যর্থতার সেই যন্ত্রণা কখনোই ভুলতে পারেননি গুরু দত্ত।

কাগজ কে ফুল সিনেমার দৃশ্যে গুরু দত্ত। ছবি: সিমোন অ্যান্ড শুস্টার

ওয়াহিদা রেহমান বলেছিলেন, 'তিনি বলতেন—লাইফ মে দো হি তো চিজ হ্যায়, কামিয়াবি অউর ফেইলর (জীবনে শুধু দুটো জিনিস: সাফল্য আর ব্যর্থতা। মাঝখানে কিছু নেই)'

এই ব্যর্থতার পর আর কোনো ছবির পরিচালনায় হাত দেননি তিনি।

চৌদভি কা চাঁদ ও সাহিব বিবি অউর গুলাম: ফিরে আসার চেষ্টা

চৌদভি কা চাঁদ দিয়ে প্রযোজক হিসেবে ফিরে আসেন। ছবিটি ছিল দারুণ বাণিজ্যিক সফল। তারপর শুরু করেন সাহিব বিবি অউর গুলাম—যেখানে এক নিঃসঙ্গ গৃহবধূর নিঃশব্দ কান্না তুলে ধরা হয়, ফিউডাল সমাজব্যবস্থার মধ্যকার নারীর অবস্থানকে প্রশ্ন করে।

কিন্তু পর্দার সেই সংবেদনশীলতা, পর্দার বাইরে আর তার ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলিত হচ্ছিল না। স্ত্রী গীতা দত্তের সঙ্গে বিচ্ছেদ, ক্রমবর্ধমান নিঃসঙ্গতা, ঘুমহীন রাত, মদ আর ঘুমের ওষুধে ভেসে থাকা এক ক্লান্ত শিল্পী হয়ে উঠছিলেন তিনি।

এক রাতে আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, তিনদিন ছিলেন অচেতন। চিকিৎসকের পরামর্শে একবার মানসিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও, পরিবার আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বোন ললিতা বলেন, "আমরা আর ডাকিনি সেই চিকিৎসককে...আজও সেটা নিয়ে আফসোস হয়।'

সাহেব, বিবি অউর গুলাম সিনেমার দৃশ্যে গুরু দত্ত ও মীনা কুমারী। ছবি: রেডিফ

এক অশ্রুসজল প্রস্থান

সাহিব বিবি অউর গুলাম–এর সাফল্য তাকে সাময়িক শান্তি দিলেও, তার ভেতরের অস্থিরতা আর অবসাদ কখনোই তাকে ছেড়ে যায়নি।

১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, মুম্বাইয়ের নিজের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় গুরু দত্তকে। মদ আর ঘুমের ওষুধ—এই ছিল শেষ রসায়ন। মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায় তিনি সন্তান অরুণ ও তরুণকে দেখতে চেয়েছিলেন। তবে গীতা রাজি হননি। গুরুর লাশের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়া গীতা নিজেও এই ধাক্কা তার পরবর্তী জীবনে আর সামলাতে পারেননি।

ওয়াহিদা রেহমান পরে লিখেছিলেন, 'আমি জানি, তিনি সেই মৃত্যু চেয়েছিলেন...সেই মৃত্যু তার চাওয়া ছিল...এবং তিনি তা পেয়েছেন।'

মৃত্যুপরবর্তী মহিমা

ঠিক যেমন পিয়াসার কবি জীবিত অবস্থায় অবহেলার শিকার হন, গুরু দত্তের প্রকৃত মূল্যায়নও আসে মৃত্যুর পর। তার প্রতিটি ছবি, প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি সংলাপে আজও অনুভব করা যায় একটি কণ্ঠস্বর—যা বলছে, 'আমি ছিলাম। আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা শুনলে না।'

চলচ্চিত্রপ্রেমীরা আজও ভাবেন—যদি গুরু দত্ত আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন, তবে ভারতীয় সিনেমা হয়তো আরও আগেই পৌঁছাত এক কবিতার উচ্চতায়, যেখানে ক্যামেরা কাঁদে, দৃশ্যেরা কথা বলে, আর পর্দার নীরবতা হয়ে ওঠে মানুষের আত্মার প্রতিধ্বনি।

গুরু দত্ত ছিলেন এক ব্যথিত কবি, যিনি সিনেমার ভাষায় নিজের হৃদয়ের আর্তনাদ শুনিয়েছেন। তিনি হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু তার ছবিগুলো আজও বেঁচে আছে—চোখে জল এনে দেওয়া এক দীর্ঘশ্বাস হয়ে।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh eyes stake in $7 trillion global halal economy: Ashik Chowdhury

Industry people join Bangladesh-Malaysia Chamber-organised seminar to explore Bangladesh’s potential

1h ago