বাস কন্ডাক্টর থেকে সুপারস্টার রজনীকান্ত
সুপারস্টার রজনীকান্ত কেবল একজন অভিনেতা নন, ভক্তদের কাছে তিনি তার চেয়েও বেশি। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয়দের কাছে তিনি দেবতার সমতুল্য। তবে, তার সুপারস্টার হওয়ার গল্প যেন সিনেমার গল্পের মতোই। শৈশবে-কৈশোরে অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে লড়াই করা রজনীকান্ত বাসের কন্ডাক্টর হিসেব কাজ করেছিলেন!
আজ ১২ ডিসেম্বর রজনীকান্তের জন্মদিন। জন্মদিনে তার সুপারস্টার হয়ে ওঠার গল্প জেনে নিন।
রজনীকান্ত ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর বেঙ্গালুরুর একটি মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হয়েছিল শিবাজি রাও গয়কয়াড়। মারাঠা যোদ্ধা ছত্রপতি শিবাজির নামানুসারে তার নামকরণ করা হয়। রজনীকান্ত ছিলেন জিজাবাঈ ও রামোজিরাও গাইকওয়াড়ের চতুর্থ সন্তান। তার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ কনস্টেবল।
এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, রজনীকান্ত মারাঠি থেকে এলেও তিনি এখনো কোনো মারাঠি সিনেমাতে অভিনয় করেননি।
শৈশব ও কৈশোরের শুরুর দিকে এই সুপারস্টারকে চরম আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছিল। তাই ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি কাঠমিস্ত্রি ও কুলিসহ বেশ কয়েকটি কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। পরে তিনি ব্যাঙ্গালুরু ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসে (বিটিএস) যোগ দেন। সেখানে তিনি বাস কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করেছিলেন। এরপর তিনি মঞ্চ নাটকে অংশ নিতে শুরু করেন। তখন নাট্যকার টপি মুনিয়াপ্পার পৌরাণিক নাটকে কাজের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন।
ওই সময়ে মাদ্রাজ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে অভিনয় ক্লাসে ভর্তির একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান। তিনি সেখানে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার পরিবার রাজি ছিল না। তাই তিনি পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সেখানে ভর্তি হন। তখন রজনীকান্তের পাশে ছিলেন বন্ধু ও সহকর্মী রাজ বাহাদুর। এই বন্ধু তাকে ভর্তির জন্য অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিলেন।
মাদ্রাজ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের একটি মঞ্চে অভিনয়ের সময় তামিল চলচ্চিত্র পরিচালক কে বালাচন্দরের নজরে পড়েন রজনীকান্ত। তিনি তাকে তামিল শেখার পরামর্শ দেন। তার পরামর্শে রজনীকান্ত একটুও দেরি করেননি। তিনি দ্রুত তামিল শিখতে শুরু করেন।
এবার রজনীকান্তের ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু করে। তিনি তামিল চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন 'অপূর্ব রাগঙ্গল' (১৯৭৫) দিয়ে। চলচ্চিত্রটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল এবং তিনটি জাতীয় পুরষ্কার জিতেছিল। পরের বছর তিনি পুত্তান্না কানাগাল পরিচালিত 'কথা সঙ্গমা' দিয়ে কন্নড় চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন।
তবে, রজনীকান্তের অনস্ক্রিন ইমেজ ফুটিয়ে তুলেছিলেন পরিচালক এস পি মুথুরামন। তিনি প্রথমে 'ভুভানা ওরু কেলভিককুরি' (১৯৭৭) সিনেমার প্রথমার্ধে কিছুটা নেতিবাচক চরিত্রে এবং পরে নায়ক হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। এরপর জে মহেন্দ্রনের 'মুল্লুম মালারাম' সিনেমার মাধ্যমে তামিল সিনেমায় নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন রজনীকান্ত।
'ভুভানা ওরু কেলভিককুরি'র সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে মুথুরামন মেলোড্রামা 'আরিলিরুন্থু আরুবাথু ভারাই' নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে রজনীকান্ত এমন এক নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি তার ভাইবোনদের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করেন।
এটি তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এই সিনেমা দিয়ে তিনি অভিনেতা থেকে অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠেন। এই সিনেমাতে তার অভিনয় কেবল দর্শকদের মুগ্ধ হয়নি, বরং কান্নায় ভেসেছিল।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে রজনীকান্ত '১৬ ভায়াধিনিলায়', 'মুন্দ্রু মুদিচু' ও 'আভারগাল'র মতো সিনেমাতে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। আশির দশকের শেষের দিকে রজনীকান্ত দক্ষিণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এরপর হঠাৎ বিরতি নেওয়া ও অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, তাকে ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল।
তিনি বলিউড সিনেমা 'ডন'র রিমেক 'বিল্লা' দিয়ে আবার চলচ্চিত্রে ফেরেন। তার দ্বৈত ভূমিকা চলচ্চিত্রটিকে বিশাল বাণিজ্যিক সাফল্য এনে দেয়। 'বিল্লা'র পর 'মুরাট্টুকালাই', 'পক্কিরি রাজা', 'থানিকাট্টু রাজা', 'নান মাহান আল্লা', 'পুদুকাভিথাই' এবং 'মুন্ড্রু মুগাম'র মতো হিট সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। কে বালাচন্দরের প্রথম প্রযোজনার 'নেত্রিকান' রজনীকান্তের ক্যারিয়ারে আরেকটি মাইলফলক হিসেবে প্রমাণিত হয়।
আশির দশকে তার বেশ কয়েকটি হিট সিনেমার মধ্যে আছে 'পাডিক্কাথাভান', 'থি', 'ভেলাইকারান', ধর্মথিন থালাইভান', 'মিস্টার ভরত' এবং 'মাভিরন'। তার শততম সিনেমা ছিল 'শ্রী রাঘবেন্দ্র', যেখানে তিনি হিন্দু সাধু রাঘবেন্দ্র স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
১৯৮৩ সালে অমিতাভ বচ্চন ও হেমা মালিনীর সঙ্গে 'আন্ধা কানুন' সিনেমা দিয়ে বলিউডে পা রাখেন রজনীকান্ত। চলচ্চিত্রটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। শুধু তাই নয় সেই সময়ে সর্বাধিক উপার্জনকারী সিনেমা হয়ে উঠেছিল। রজনীকান্ত ও অমিতাভ বচ্চনের মধ্যে প্রথম সিনেমা দিয়ে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর তারা 'গ্রেপ্তার' ও 'হাম'র মতো হিন্দি সিনেমাতে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন।
নব্বইয়ের দশকে রজনীকান্তের সবচেয়ে বেশি সফল সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। যেমন- 'থালাপাতি', 'মান্নান', 'আন্নামালাই', 'উজাইপ্পালি', 'বীরা', 'বাশা', 'মুথু', 'অরুণাচলম' এবং 'পাদায়াপ্পা'।
১৯৯১ সালে বলিউড ফ্লিক 'হাম' চলচ্চিত্রে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দ্বিতীয় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। একই বছর মণি রত্নমের 'থালাপাতি' সিনেমাতে অভিনয় করেন, সিনেমাটি মহাভারত থেকে অনুপ্রাণিত। রজনীকান্ত প্রথম চিত্রনাট্য 'ভাল্লি' লিখেছিলেন এবং ১৯৯৩ সালে এতে অভিনয়ও করেছিলেন। কিন্তু, এটি বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছিল।
রজনীকান্ত অভিনীত 'বাশা' বিশাল ব্লকবাস্টার হয়ে ওঠে এবং কাল্ট স্ট্যাটাস অর্জন করে। যা তাকে ভক্ত ও অনুসারীদের কাছে দেবতা সমতূল্য করে তোলে। তার 'মুথু' ছিল প্রথম তামিল সিনেমা, যা জাপানি ভাষায় ডাবিং করা হয়েছিল। 'মুথু: দ্য ডান্সিং মহারাজা' জাপানে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
রজনীকান্তের ১৫০তম চলচ্চিত্র 'পাদায়াপ্পা' তার অভিনয় ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছিল। এরপর তিনি প্রায় তিন বছরের বিরতি নেন। পরে তার নিজের প্রযোজনা 'বাবা'তে অভিনয় করেছিলেন, সিনেমাটির ২০০২ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তি পেয়েছিল। তবে দুর্বল চিত্রনাট্যের কারণে সিনেমাটি ভক্তদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল। রজনীকান্ত নিজেই এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন।
'ভাল্লি'র পর চিত্রনাট্যকার হিসেবে এটি রজনীকান্তের দ্বিতীয় ব্যর্থতা। যদিও চলচ্চিত্রটি বাজেট তুলে আনতে পেরেছিল। কিন্তু তার অন্যান্য সিনেমার আয়ের তুলনায় বড় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
'বাবা'র হতাশার পর রজনীকান্ত সিনেমা থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তখন কিছুদিনের জন্য রাজনীতিতে আগ্রহ দেখান। পরে তিনি অনেক স্ক্রিপ্ট পড়েন, বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। অবশেষে পি ভাসুর তামিল রিমেক 'মানিচিথ্রাথাঝু', 'চন্দ্রমুখী'তে অভিনয় করেন। এটিকে তার প্রত্যাবর্তন চলচ্চিত্র বলে মনে করা হয়।
২০০৫ সালের ১৪ এপ্রিল মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি তার আগের বক্স অফিসের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। সিনেমাটি দুর্দান্ত হিট হয়ে ওঠে। এর পরে আরও একটি ব্লকবাস্টার 'শিবাজি: দ্য বস' মুক্তি পেয়েছিল, যা পুরো দুই বছরের চিত্রগ্রহণ ও প্রযোজনার পরে ২০০৭ সালের ১৫ জুন মুক্তি পেয়েছিল।
শিবাজি হলো প্রথম তামিল সিনেমা, যা মুক্তির পরে যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার বক্স অফিসের শীর্ষ ১০ সেরা চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি হয়েছিল।
রজনীকান্ত এরপর পি ভাসুর 'কুসেলান' সিনেমাতে কাজ করেন। এটি ছিল মালায়ালাম সিনেমা 'কাধা পারায়ুম্বল'র রিমেক। তবে, সিনেমাটি বক্স অফিসে খুব খারাপ পারফরম্যান্স করেছিল।
২০১০ সালে রজনীকান্ত আবারও পরিচালক শঙ্করের সঙ্গে টেকনো থ্রিলার 'এন্ধিরান' সিনেমাতে জুটি হন। এই সিনেমাতে ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন ও ড্যানি ডেনজংপাও অভিনয় করেছিলেন। সিনেমাটিকে সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ভারতীয় চলচ্চিত্র বলা হয় এবং সে সময় ভারতের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চলচ্চিত্রে পরিণত হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার 'আন্নাথে' ও খুব সাম্প্রতিক 'জেলার' সিনেমাও ব্লকবাস্টার হয়েছে।
রজনীকান্ত তার ক্যারিয়ারে ছয়টি তামিলনাড়ু রাজ্য চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতেছেন। এর মধ্যে চারটি সেরা অভিনেতার পুরষ্কার এবং সেরা অভিনেতার জন্য দুটি বিশেষ পুরষ্কার। এছাড়া একটি ফিল্মফেয়ার সেরা তামিল অভিনেতা পুরষ্কার জিতেছেন। তিনি ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণে ভূষিত হয়েছেন। সর্বশেষ মর্যাদাপূর্ণ দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার জেতেন এই অভিনেতা।
Comments