ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শাহরুখের জনপ্রিয়তা

ঈদুল ফিতরের দিন শাহরুখের বাড়ির সামনে ভক্তদের জমায়েত। ছবি: সংগৃহীত

১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন, ২৬ বছর বয়সে হারান মাকেও। একমাত্র বোন এই শোক সইতে পারেননি, অবসন্নতাসহ মানসিক অসুখের শিকার হন তিনি। সেই দুঃসময়ে পাশে কেউ ছিল না। অথচ এখন তার বাড়ির সামনে ভিড় করে লাখো মানুষ। গোটা বিশ্বে এক নামে পরিচিত তিনি। তিনিই বলিউড বাদশাহ, 'লাস্ট অব দ্য স্টারস' শাহরুখ খান।

বর্তমান এই গ্ল্যামারের পেছনে শাহরুখের জীবনের একাকীত্বের করুণ ছায়া, অসহায়ত্ব ও অবসাদও রয়েছে।

মাত্র ১৫০০ রুপি নিয়ে মুম্বাই এসেছিলেন শাহরুখ

দিল্লির মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শাহরুখ খানের বাবা এসেছেন পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরের 'কিসসা খোয়ানি বাজার' থেকে। 'কিসসা' শব্দের অর্থ 'গল্প' আর খোয়ানি মানে 'কাহিনী'। 'কিসসা খোয়ানি বাজারে'র অর্থ হলো গল্পকারদের বাজার। দেশ-বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা সেখানে ফল বিক্রি করতে যেতেন, সঙ্গে নিয়ে যেতেন গল্পের ঝুড়িও। সেখান থেকেই এই নাম। শুধু শাহরুখ খান নন, রাজ কাপুর ও দিলীপ কুমারের মতো গল্পকাররাও এসেছেন এই গল্পের গলি থেকে।

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলায় শাহরুখ হতে চেয়েছিলেন একজন অ্যাথলেট। সেন্ট কলম্বাসে পড়ার সময় হকি ও ফুটবলে অসাধারণ পারফর্ম্যান্সের জন্য তিনি পেয়েছিলেন 'সোয়ার্ড অব পারফর্ম্যান্স' পুরস্কার। দিল্লির হানস রাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া থেকে গণযোগাযোগ বিভাগে স্নাতকোত্তর পড়াকালে অভিনয় শেখার জন্য 'থিয়েটার অ্যাকশন গ্রুপে' ভর্তি হন তিনি। টেলিভিশনে অভিনয় দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন শাহরুখ। তার প্রথম অভিনীত ধারাবাহিক 'ফৌজি' মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে।

১৯৯১ সালের এপ্রিলে মাকে হারানোর পর দিল্লি ছেড়ে স্বপ্নের নগরী মুম্বাইতে আসেন তিনি। পকেটে তখন মাত্র দেড় হাজার রুপি। মুম্বাইতে এসেই চারটি সিনেমায় নাম লেখান শাহরুখ। প্রথমটি অভিনেত্রী হেমা মালিনীর নির্দেশিত সিনেমা 'দিল আশনা হে'। যদিও শাহরুখ খানের প্রথম মুক্তি পাওয়া সিনেমা 'দিওয়ানা'। এই সিনেমায় রিশি কাপুর ও দিব্য ভারতীর সঙ্গে অভিনয় করেন তিনি।

খল চরিত্র থেকে 'কিং অব রোমান্স', শাহরুখ কেন এত জনপ্রিয়

বলিউডে শাহরুখ সবার নজর কাড়েন 'দিওয়ানা', 'আঞ্জাম', 'ডর' ও 'বাজিগরে'র মতো সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করে। কিন্তু খল চরিত্রে অভিনয় থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন শাহরুখ। এই যাত্রায় তার সঙ্গী হন আদিত্য চোপড়া ও বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা যশ রাজ ফিল্মস। মুক্তি পায় বলিউডের অমর প্রেম আখ্যান 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে'। সিনেমাটি এতটাই দর্শকপ্রিয় যে এখনো প্রতি শুক্রবার মুম্বাইয়ের মারাঠা মন্দির সিনেমা হলে এটি প্রদর্শিত হয়। এরপর শাহরুখ ক্রমাগত রোমান্টিক সিনেমাতেই অভিনয় করে যান। 'দিল তো পাগাল হে', 'কুছ কুছ হোতা হে', 'কাভি খুশি কাভি গাম', 'ভির জারা' এরকম অসংখ্য রোমান্টিক সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি।

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

শাহরুখ খানের সিনেমা ও চরিত্র বাছাই তাকে তার সমসাময়িক অন্যান্য অভিনেতাদের থেকে আলাদা করে। আশির দশকের শেষে ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হিন্দি সিনেমায় যারা দাপিয়ে বেড়ান, অতিপুরুষালি আচরণে ভরপুর সেসব সিনেমায় নায়িকাকে চড় মারতেও দ্বিধা করেনি সেই চরিত্রগুলো।

ঠিক এসময়ই শাহরুখ এমন সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন যেখানে তাকে মায়েদের সঙ্গে ঘরের কাজ করতে দেখা যায়। নায়িকাদের যত্ন নিতে দেখা যায়। মায়ের সবথেকে আদরের সন্তান, শিশুদেরও পছন্দের। পর্দায় একইসঙ্গে রোমান্স, অ্যাকশন, কমেডি আবার ন্যায়পরায়ণ, নিষ্ঠাবান সবকিছুই সফলভাবে ফুটিয়েছেন তিনি। সাধারণ মানুষ মাত্রই যে হিরো হতে পারে এবং একজন হিরো বা নায়ক যে সাধারণ মানুষ ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়, তা প্রমাণ করেছেন চলচ্চিত্র জগতে পা রেখেই। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন 'কিং অব রোমান্স'।

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

বলা হয়ে থাকে, শাহরুখের এত জনপ্রিয়তার মূলে একটি বড় ভূমিকা রয়েছে তার নারী ভক্তদের। ভারতবর্ষে এমন কোনো নারী পাওয়া দুষ্কর যিনি শাহরুখের ভক্ত নন। এ কারণ মূলত তার অভিনীত চরিত্রগুলোই, নারীদের কাছে আদর্শ প্রেমিক বলতে যা বোঝায় এর প্রতিচ্ছবি দেখা যায় এসব চরিত্রে।

পর্দায় বাইরে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপের সময়, কিংবা ভক্তদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময়ও তার মার্জিত আচরণ, রসবোধ ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শাহরুখকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়।

শাহরুখ খানের মতে, তার জীবনের একটাই অপূর্ণতা যে এই যশ-খ্যাতি তার বাবা-মা দেখে যেতে পারেনি। দ্য অনুপম খের শোতে অভিনেতা অনুপম খের তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'কখনো কি মনে হয় আপনার পর কোনো সুপারস্টার আসবে?' জবাবে শাহরুখ বলেন, 'আই এম দ্য লাস্ট অব দ্য স্টারস।'

ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শাহরুখের জনপ্রিয়তা যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিকবার ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর রোষানলে পড়তে হয়েছে শাহরুখকে। ২০২৩ সালে 'পাঠান' ছবির একটি গান, 'বেশরম রং' মুক্তির পর নায়িকা দীপিকা পাড়ুকোন 'গেরুয়া রংয়ের ছোট পোশাক পরে একজন মুসলিম নায়কের সঙ্গে নেচেছেন এবং হিন্দুত্বের অবমাননা করেছেন' এমন আলোচনাও শুরু হয়।

উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা 'পাঠানে'র পোস্টার ছিঁড়ে, ভাঙচুর করে ও শাহরুখের ছবিতে লাথি মেরে প্রতিবাদ জানালেও বক্সঅফিসে বাজিমাত করে সিনেমাটি। 

এর আগে, প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্যে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে শাহরুখ খান 'থুথু ছিটিয়েছেন' এমন গুজবও ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেসময় শাহরুখ ভক্তরা সোচ্চার হয়ে এর প্রতিবাদ করেন।

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ক্ষমতায় আসার ঠিক এক বছর পর বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারতে মুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণুতা ক্রমাগত বাড়ছে।

এরপর থেকেই ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর রোষানলে পড়েন তিনি। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদ যোগী আদিত্যনাথ এক বক্তৃতায় শাহরুখকে একজন পাকিস্তানি জঙ্গির সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং তাকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলেছেন। 

২০১৬ সালের পর ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে আর কোনো প্রকাশ্য বিবৃতি দেননি শাহরুখ। তবে ২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দুই সিনেমা 'পাঠান' ও 'জওয়ান' এ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা রয়েছে। 

২০২১ সালে শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ানকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তারের ঘটনাকেও কিছু বিশ্লেষক 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' বলে মনে করেন।

শাহরুখ খানের ধর্ম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের এক বিনোদন প্রতিবেদক ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'শাহরুখ এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি সবসময় উদারনৈতিক মূল্যবোধ বহন করেন। তিনি অত্যন্ত প্রগতিশীল। একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তিনি একজন মুসলিম ব্যক্তিত্ব। তার ব্যক্তিগত জীবন—তিনি একজন হিন্দু নারীকে বিয়ে করেছেন। সন্তানদের কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মে বড় করেননি। বলেছেন, তারা যে ধর্ম অনুসরণ করতে চায়, সেটি করবে।' 

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেমা স্টাডিজের অধ্যাপক ড. রঞ্জনী মজুমদার বলেন, 'সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের কারণে শাহরুখের ধর্ম এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন মুসলিমদের বিরুদ্ধে এত বিষ ঢালার পরেও শাহরুখের জনপ্রিয়তা হারায় না। শাহরুখ কখনো জনসমক্ষে তার ধর্মকে সামনে আনেননি। ভারতে তার যে জনপ্রিয়তা তাতে বোঝা যায় তার বিপুল সংখ্যক ভক্তদের কারো কাছেই তার ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি হিন্দুত্ববাদীদের পছন্দ হওয়ার কথা নয়।'

সাংবাদিক রানা আইয়ুবের মতে, ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বলিউডের যে ব্যাপক শক্তি সেটিকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের অপমান করার জন্য ব্যবহার করতে চাইছে। এই কারণেই শাহরুখ তাদের জন্য 'শত্রু' হয়ে উঠেছেন। 

রানা আইয়ুব বলেন, 'হিন্দুত্ববাদীরা পর্দায় মুসলিম পুরুষদের নেতিবাচক উপস্থাপন দেখতে পছন্দ করে। সেখানে একজন মুসলিম নায়কের আধিপত্য তাদের জন্য কিছুটা বিরক্তির কারণ তো হবেই। অথচ দেখুন, 'জওয়ান' সিনেমায় যা বলা হয়েছে, "জাতি ও ধর্ম দেখে নয়, এমন প্রার্থীকে ভোট দিন যিনি আপনার জন্য কাজ করবে" এটি খুবই সাধারণ একটা বার্তা, অসাধারণ কিছু নয়। কিন্তু আমরা যে সময়ের মধ্যে বাস করছি, তার মধ্যে এটিই হয়ে গেছে বিরাট সাহসী কাজ!'

ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের আমলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিতর্কের পটভূমিতে বিজেপি নেতাদের প্রবল তোপের মুখেও অভিনয় ও অসামান্য ব্যক্তিত্বের জোরে নিজের মুকুট সগৌরবে ধরে রেখেছেন শাহরুখ। ঈদ কিংবা কোনো সিনেমা মুক্তি অথবা শাহরুখের জন্মদিনে তার বাড়ির সামনে কয়েক লাখ ভক্তের জমায়েতই এর প্রমাণ।

তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ডয়েচে ভেলে, দ্য অনুপম খের শো

 

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

6h ago